সিরাজগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্র কাটাখাল ও আশপাশের এলাকার সৌন্দর্যবর্ধনের নামে দাতা সংস্থার মাধ্যমে কয়েক বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। খালটি এখনও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ই রয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে যমুনার পানি প্রবেশ করলেও অন্য সময় অনেকটা মরা পড়ে থাকে। পৌরসভার নামে বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগই আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের। জানা গেছে, উচ্চহারে সুদের প্রতিশ্রুতিতে দাতা সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ৫০ কোটি টাকা খরচের পরও শহরের ঐতিহ্যবাহী ‘কাটাখাল’ এখনও আবর্জনার ভাগাড়। দুই পাশে বসবাস করা শহরের বাসিন্দারা প্রতিদিন গৃহস্থালির বর্জ্য খালে ফেলছেন। এতে মশা-মাছির আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে এটি। সন্ধ্যার পর মাদকসেবীদের আনাগোনাও দেখা যায়। তীর রক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াই অপরিকল্পিতভাবে দু’পাশে নির্মিত ‘ফুটওয়াক’ বা পায়ে হাঁটার রাস্তার কংক্রিটও ধসে গেছে। কাটাখাল-সংলগ্ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গলির বাসিন্দা আব্দুস সাত্তারের বলেন, ২০০৩ সালে কাটাখালের সৌন্দর্য বর্ধনে উভয় পাড়ে কয়েক হাজার বসতি উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু বর্তমানে সৌন্দর্যবর্ধন দূরের কথা, ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। একই এলাকার স ম আহসান হাবীব মুন্না বলেন, কাটাখালের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য পরিকল্পনামাফিক প্রকল্প হাতে নেওয়া দরকার। ময়লা-আবর্জনা এবং তাঁত ও সুতা রঙের কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য পানি খালে না ফেলার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। ষাটের দশকে তৎকালীন মহকুমাবাসীর চলাচল ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়নে ‘কাটাখাল’ খনন হয়। পরে দুই পাশে ক্রমেই দখল হতে থাকে। অতীতে শহরের গোশালা থেকে কাটাখালের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতা বন্দরে নদীপথে পাট রপ্তানি হলেও এটি এখন রূপকথা গল্পের মতো। দীর্ঘদিন ধরে পৌরসভা সংস্কারের কোনো উদ্যোগও নেয়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাবেক মেয়র সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তার সময় উচ্চহারে সুদের প্রতিশ্রুতিতে জার্মান দাতা সংস্থা ‘কেএফডব্লিউ’র ঋণের ৫০ কোটি টাকা খরচ করা হয় কাটাখাল খনন ও সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্পের নামে। কিন্তু দুই পাশে নালা না থাকা এবং ময়লা-অবর্জনা বা বাজারের মাছ-মাংসের বর্জ্য অপসারণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে কিছুদিন না যেতেই ভেস্তে যায় প্রকল্পটি। ফের এটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়। সম্প্রতি পৌরসভা থেকে দুই পাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি নেওয়া হয়। তবে তা ছিল অনেকটা দায়সারা। ময়লা-আবর্জনা ও ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করে তা খালেই ফেলতে দেখা যায় দৈনিক মজুরভিত্তিক পৌরসভার শ্রমিকদের। সরেজমিন দেখা গেছে, স্থানীয় বাসিন্দারা ময়লা-আবর্জনা ফেলছেন কাটাখালে। রেলগেট ও বড়বাজারের মাছ-মাংস, জবাই পশু ও মাছ-মুরগির বর্জ্যও ফেলা হয়েছে। মিরপুর ও বিড়ালাকুঠি থেকে সুতা রং কারখানার বর্জ্যরে কারণে পানি দূষিত হয়ে গেছে। সাড়ে ২১ কিলোমিটার খালের প্রায় সাড়ে ৮ কিলোমিটার অংশ গত তিন বছরে খনন করা হয়েছে। কিন্তু আবর্জনা ফেলায় তা কাজে আসছে না। শহরের মুজিব সড়কের সুইপার কলোনির পাশে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে জার্মান দাতা সংস্থার মাধ্যমে পৌরসভার আরেকটি প্রকল্পের আওতায় কসাইখানা ও মাছ-মুরগির শেড তৈরি হয়েছে। তবে এখনও চালু হয়নি। নির্মাণের পর তিন বছর ধরে পড়ে রয়েছে। বিক্রেতারা পুরোনো বাজার ছেড়ে সেখানে যেতে চান না। এরই মধ্যে কাটাখাল সংস্কার ও খননসহ সৌন্দর্যবর্ধনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা সম্প্রতি বড়বাজারের টুকু ব্রিজের ওপর মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চুসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এতে অংশ নেন। সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, ২০০৩ সালে কাটাখাল যখন খনন করা হয়, তখন দু’ধারে কয়েক হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। তারা মানবেতর জীবনযাপন করলেও শহরের উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে আন্দোলনে যায়নি। পরে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে দাতা সংস্থা থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে নয়ছয় ও লুটপাট করা হয়েছে। পতিত সরকারের সাবেক মেয়র সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তাসহ পৌরসভা ও প্রকল্পের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী লুটপাট করেছেন। স্থানীয় সরকার অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রকল্পের বরাদ্দের সঠিক তদন্ত ও অভিযুক্তদের শাস্তির দাবি জানান তিনি। পৌরসভার সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সালাম বলেন, ‘কাটাখাল ও আশপাশের এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধনসহ তিনটি সেতু নির্মাণে অর্ধশত কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও পরে আরও ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়নি। যে কারণে প্রকল্পটি শেষ করা সম্ভব হয়নি। সুইপার কলোনির পাশে ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পৃথক কসাইখানা ও মাংস-মুরগির শেড করা হলেও ব্যবসায়ীরা যাননি। আর শুধু সংস্কার যথেষ্ট নয়, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলাও বন্ধ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী আবু হেনা মোস্তফা। বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী নুরন্নবী কাটাখালের সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, ‘কাটাখালের ঝোপঝাড় পরিষ্কারে দৈনিক হাজিরার শ্রমিকরা কাজ করছেন।’ পৌরসভার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসক স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিচে রক্ষিত বাক্সে কাটাখাল সম্পর্কে শহরবাসী চাইলে অভিযোগ দিতে পারেন।’ পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সৈয়দ আব্দুর রউফ মুক্তা মামলার কারণে পালিয়ে থাকলেও হোয়াটসঅ্যাপে বলেন, কাটাখালের সৌন্দর্যবর্ধনে ৫০ কোটি টাকার মধ্যে তিনটি বড় সেতু করা হয়েছে। দুর্নীতির কথা বললেই তো হবে না, প্রমাণ করতে হবে। খালের দুই পাশে হাঁটার রাস্তা নির্মাণ ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। পাশাপাশি গোশালা রেলগেট থেকে রানিগ্রাম পর্যন্ত রাস্তা ও রাসেল পার্কের সংস্কার করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে অডিট সম্পন্ন হলেও কোনো আপত্তি জানানো হয়নি।