নিজস্ব প্রতিবেদক
গত কিছুদিনের বৃষ্টিতে সিলেট অঞ্চলে প্রকৃতি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। গাছগাছালি ও পত্রপল্লব থেকে রুক্ষতা দূর হয়ে গেছে। সিলেটের চা-বাগানগুলোতে গেলে প্রকৃতির এই রূপান্তর সহজেই অনুভূত হয়। কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলেন, দীর্ঘ খরা পরিস্থিতির পর এই বৃষ্টি যেন ‘আশীর্বাদ’ হিসেবেই নেমেছে। সাধারণত ডিসেম্বর মাসে কয়েক পশলা বৃষ্টিপাত হয় এই অঞ্চলে; কিন্তু এবার ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে বৃষ্টি হয়নি। টানা খরা চলে সিলেটে। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় পক্ষে যৎসামান্য বৃষ্টি হলেও তাতে চা-বাগানগুলো থেকে রুক্ষতা কাটেনি। অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর মার্চে সিলেট বিভাগের প্রতিটি জেলায় কিছু না কিছু বৃষ্টি হলে স্বস্তি ফিরে আসে সবার মধ্যে। এই বৃষ্টির ফলে পুনিং (আগা ছাঁটাই) করা চাগাছে দ্রুত কুঁড়ি গজাতে শুরু করবে। এতে খুশি চা-বাগান মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলসহ চা-শিল্পাঞ্চলে রবিবার সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত তিন দফায় ১৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে বলে জানিয়েছেন শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষক বিভলু চন্দ্র দাস। এরপর গত সোমবার থেকে বিচ্ছিন্নভাবে সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হয়। সিলেট আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক সজিব আহমদ শনিবার বিকালে ইত্তেফাককে বলেন, এই মাসে আরো কয়েক দিন বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি মার্চ মাসে এ পর্যন্ত ১৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ের বৃষ্টি সিলেট অঞ্চলের চা-শিল্পের জন্য অনেক উপকারী। গত ১৫ মার্চ ভোরে সিলেটের তপ্ত মাটি সিক্ত হয় মাত্র ২২ মিলিমিটারের বৃষ্টিতে। চা-বাগানের বিবর্ণ পত্রপল্লবে সজীবতা ধরা দেয়। ১৯, ২০ ও ২১ মার্চের সামান্য বৃষ্টিতে সিলেট ভ্যালির ২২টি চা-বাগানে প্রাণ ফিরে আসে, বিশেষ করে হাবিব নগর, খাদিম চা-বাগান, খান বাগানসহ খরায় দুর্দশাগ্রস্ত কয়েকটি বাগান এই বৃষ্টিতে বিশেষভাবে উপকৃত হয়। বিভিন্ন চা-বাগানের ব্যবস্থাপকরা জানান, টানা অনাবৃষ্টিতে চা-গাছগুলো মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এতে তারা সবাই দুশ্চিন্তায় ছিলেন। এখন বৃষ্টি হওয়ায় চা-গাছ কুঁড়ি ছাড়তে শুরু করেছে। সূত্র মতে শ্রীমঙ্গলের কিছু বাগানে সেচের ব্যবস্থা থাকলেও অধিকাংশ বাগানেই তা নেই। তাই সিলেটের চা-বাগানগুলো প্রায় প্রতি বছরই খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কুলাউড়ার ফুলবাড়ী ও নূর জাহান চা-বাগানের জিএম লুৎফুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দুটি বাগানে এবার চা উৎপাদনের টার্গেট ৭ লাখ ৩০ হাজার কেজি; কিন্তু আবহাওয়ার যা অবস্থা ছিল তাতে আমরা বেশ উদ্বিগ্ন ছিলাম। অবশেষে বৃষ্টি নামায় সবার মধ্যে অনেকটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে এখনো ভালো খবর দেওয়ার সময় আসেনি। সিলেটের হরিপুরস্থ ‘হাবিব নগর চা-বাগান’-এর ব্যবস্থাপক হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘চা একটি সংবেদনশীল কৃষিপণ্য। এর জন্য প্রয়োজন সুষম আবহাওয়া, সঠিক পরিচর্যা।’ সারা দেশের ১৬৭টি চা-বাগানের মধ্যে সিলেটেই আছে ১৩৬টি। বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের নর্থ সিলেট ভ্যালির চেয়ারম্যান নোমান হায়দার বলেন, আশা করছি এর মধ্যে আরো ভালো বৃষ্টি হবে। সংকটজনক পরিস্থিতি কেটে যাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বৃষ্টির অভাবে অনেক সময় চা-বাগানে ‘রেড স্পাইডার’সহ নানা ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণের আশঙ্কা থাকে। এতে চা-উৎপাদন হ্রাস পায়। চায়ের মওসুম এপ্রিল থেকে নভেম্বর। সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর—এই চার মাসেই উৎপাদিত হয় ৬০ শতাংশ চা। চা-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত বছর খরা, নানা রোগ এবং চা-শ্রমিকদের টানা অবরোধের কারণে উৎপাদন মারাত্মক হ্রাস পায়। এছাড়া গত ১০ বছরেও চায়ের নিলামে মূল্য না বাড়ার কারণে সেভাবে বাড়ছে না উৎপাদন। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আশরাফুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, বৃষ্টিপাত চা-শিল্পের জন্য সুফল বয়ে এনেছে। এখন চা-গাছে দ্রুত নতুন কুঁড়ি চলে আসবে। প্লাকিং শুরু হবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চা উৎপাদিত হবে। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে দেশে চা উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০০ মিলিয়ন কেজি। ২০২২ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০০ মিলিয়ন কেজি; কিন্তু বন্যা ও চা-শ্রমিকদের আন্দোলনসহ নানা কারণে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে ১৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে সরকার। এর মধ্যে ১৩০ মিলিয়ন কেজি চা দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ করা হবে এবং বাকি ১০ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রপ্তানি করা হবে। এমনই সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের (বিটিবি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম।