ঢাকা, শুক্রবার, ৩১শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ

ফুটবল দিয়ে বাল্যবিবাহ ‘ঠেকানো‘ কামরুন্নাহারের গল্প

নারীদের ফুটবলে এগিয়ে নিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘মোনালিসা ওমেন্স স্পোর্টস একাডেমি’। সেখানে ১৮ জন মেয়ের প্রশিক্ষণ চলছে। সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মেয়েদের হঠাৎ বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। যে বয়সে মেয়েদের লেখাপড়া আর হাসিখেলায় মেতে থাকার কথা, সেই বয়সে তাদের ধরতে হচ্ছিল সংসারের হাল। নিজ ছাত্রীদের এমন পরিণতি দেখে কেঁদে ওঠে স্কুলশিক্ষিকা কামরুন্নাহার মুন্নির মন। তাই বাল্যবিয়ে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে ছাত্রীদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন তিনি। পেশায় শিক্ষিকা কামরুন্নাহার নারীদের ফুটবলে ‘বিপ্লব ঘটানো’ এবং ‘বাল্যবিবাহ রোধে’ সমানতালে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে এরই মধ্যে অনেক মেয়ের জীবনের গতিপথে পরিবর্তন এনেছেন। পুরুষদের পাশাপশি নারীদের ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নারীদের ফুটবলে এগিয়ে নিতে কামরুন্নাহার প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘মোনালিসা ওমেন্স স্পোর্টস একাডেমি’। এ পর্যন্ত প্রায় ৩৮ জন নারীকে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করেছেন তিনি। এখন এডাডেমিতে ১৮ জন মেয়ের প্রশিক্ষণ চলছে। আর এ কাজে তাকে সহযোগিতা করছেন স্বামী আনোয়ার সাদাত উজ্জ্বল ও টাঙ্গাইলের ব্যবসায়ী মির্জা মাসুদ রুবল। সমাজের ‘প্রতিকূল’ পরিবেশের বিরুদ্ধে কিভাবে ‘সংগ্রাম’ চালিয়ে যাচ্ছেন সে গল্প বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে শুনিয়েছেন কামরুন্নাহার। তিনি বলেন, ২০১০ সালে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ‘বাবুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সে সময় স্কুলের শিশু-কিশোরদের নিয়ে নানা খেলাধূলার আয়োজন করতেন। ২০১২ সালে ‘টাঙ্গাইল প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে’ এক বছরের জন্য প্রশিক্ষণে অংশ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে স্কুলে ফিরে গিয়ে দেখেন অনেক মেয়েই নেই; কারণ তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। কিছুদিন পর বাল্যবিয়ের শিকার এক ছাত্রীর সঙ্গে তার দেখা হয়। তার কাছ থেকে জানতে পারেন, ছোট ছোট মেয়েদের বাল্যবিয়ের ঘটনা। তখনই তিনি মেয়েদের বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। যেহেতু বিষয়টা সামাজিক ব্যাধিতে রুপ নিয়েছে, তাই চিন্তা করতে থাকেন কীভাবে মেয়েদের রক্ষা করা যায়। এরই মধ্যে ২০১৪ সালে ‘বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেণ্ট’ শুরু হয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ফুটবলের মাধ্যমেই এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব। কামরুন্নাহার বলেন, এক্ষেত্রে দুটি সমস্যা তার সামনে ছিলো- একইতো মেয়ে, তার উপর মেয়েদের ফুটবল খেলানো মানে ঘুনে ধরা সমাজের রেওয়াজের বিরুদ্ধে যাওয়া। তারপরও তিনি দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মেয়েদের ফুটবল শেখাতে থাকেন। সে সময় বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের নিয়ে ফুটবল দল গঠন করা হয়। তিনিও তার স্কুলে ফুটবল দল গঠন করেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কামরুন্নাহার টাঙ্গাইল শহরের ‘উত্তরণ শিশু শিক্ষালয়ে’ বদলি হয়ে আসেন। এরপর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে দল গঠনসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পান তিনি। এ সময় গ্রামের বিভিন্ন স্কুলের মেয়েদের ফুটবল খেলায় সম্পৃক্ত করতে থাকেন। কিন্তু দেখা যায়- অনেক পরিবার মেয়েদের খেলাধূলা করতে দিতে রাজি না। অনেক দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা নিয়মিত টাঙ্গাইলে এসে অনুশীলনে অংশও নিতে পারে না। সেই মেয়েদের নিজের বাসায় রেখে অনুশীলন করানোর ব্যবস্থা করেন। এক পর্যায়ে ‘মোনালিসা ওমেন্স স্পোর্টস একাডেমি’ গঠন করেন কামরুন্নাহার। এই একাডেমিতে মেয়েদের নিয়মিত ফুটবল প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এখন ১৮ জন মেয়ের প্রশিক্ষণ চলছে। তাদের সবার থাকা-খাওয়া ও অনুশীলনের সব দায়িত্বও কামরুন্নাহারের কাঁধে। শুরুর দিকে নিজের আয়ের জমানো টাকা খরচ করে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিতেন কামরুন্নাহার। পরে ‘ডেইলি স্টার আনসাং ওমেন্স নেশন বিল্ডার্স’ পুরস্কার লাভ করেন। সেই পুরষ্কারের দুই লাখ টাকার পুরোটাই তিনি খরচ করেছেন তার একাডেমিতে। এ পর্যন্ত ৩৮ জন মেয়েকে বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করেছেন জানিয়ে কামরুন্নাহার বলেন, ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভূঞাপুরের সপ্তম শ্রেণীর এক মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। খবর পেয়ে মেয়েটির অভিভাবকের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। তাদের বুঝিয়ে মেয়েটিকে নিজের একাডেমিতে নিয়ে যান। কিছুদিন পর শোনেন, বিয়ে ভেঙে গেছে। তিনি আর বলেন, “মেটির মাথায় লম্বা চুল আর দেখতেও সুন্দর ছিল। ওকে বাসা থেকে লুকিয়ে বের হয়ে সেলুনে গিয়ে চুল কেটে ফেলতে বলি। বিয়ে ভাঙতে মেয়েটিও তাতে রাজি হয়েছিল। সেই মেয়ে পরে বিকেএসপিতে (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) প্রমীলা ফুটবল প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সুযোগ পায়।” শিক্ষক কামরুন্নাহার মুন্নি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) বি ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করেছেন। এর আগে ‘সি’ লাইসেন্স কোর্স করেছেন। বিকেএসপিতেও করেছেন ‘কোচেস’ কোর্স। কামরুন্নাহারের একাডেমির মেয়েদের নিয়ে গড়া টাঙ্গাইল জেলা দল ২০২১ সালে এবং ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৭ ফুটবল টুর্নামেণ্টে ঢাকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসে আনসারের হয়ে খেলেছেনে একাডেমির ফুটবলার সিরাত সাবরিন ও রূপা আক্তার। বাংলাদেশ গেমসে রৌপ্যজয়ী রাগবি দলের সবাই এই একাডেমির। বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন আট নারী ক্যাডেট ফুটবলার। এ ছাড়া বিকেএসপির স্বল্প মেয়াদি-দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অন্তত ২৫ জন। ৩৬ বছর বয়সী নিঃসন্তান কামরুন্নাহার জানালেন, একাডেমির মেয়েরাই তার আদরের সন্তান; তাদের নিয়েই তার সব ভাবনা। মেয়েরা খেলতে চায়। কিন্তু অনেক পরিবার মেয়েদের খেলতে দিতে চায় না। তিনি মনে করেন, খেলার মাধ্যমেই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। “খেলায় যুক্ত হলে মেয়েদের মধ্যে একটা নেতৃত্ববোধ তৈরি হওয়ার পাশাপাশি মনের সংকীর্ণতা দূর হয়।” কামরুন্নাহারকে নিয়ে তৈরি করা একটি প্রামাণ্যচিত্র ৭৪তম কানচলচ্চিত্র উৎসবে বাণিজ্যিক শাখায় ‘মার্সে দ্যু ফিল্ম’-এ নির্বাচিত হয়ে পুরস্কার লাভ করে। প্রামাণ্যচিত্রটির কারণে কামরুন্নাহারের বাল্যবিয়ে ঠেকানোর কথা দেশ পেরিয়ে বিশ্বের কাছে পৌঁছে গেছে। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি জানতে চাইলে কামরুন্নাহার বলেন, “বাল্যবিয়ে রোধ ও এবং ফুটবল নিয়ে চলমান কাজের প্রসার ঘটাতে চাই। প্রথম যখন মেয়েদের নিয়ে ফুটবল অনুশীলন শুরু করি, তখন অনেকেই বলতেন- এটা আমার পাগলামি। ধীরে ধীরে সফলতা আসছে।” “এখন অনেকেই এটাকে আর পাগলামি মনে করে না। কোনো মেয়ের শিক্ষাজীবন যেন ঝরে না যায়, কাউকে যেন বাল্যবিয়ের শিকার হতে না হয় সেজন্য আজীবন কাজ করে যেতে চাই।” কামরুন্নাহারের স্বামী মোহাম্মদ আনোয়ার সাদাত উজ্জ্বল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সুবিধা বঞ্চিত, বিদ্যালয়ে ঝরে পড়া মেয়েদের ফুটবল খেলাধুলা শেখানোর কামরুন্নাহারের এ ইচ্ছেকে আমি সম্মান দেই। তার দৃষ্টিভঙ্গি ভালো, এটা ভালো লাগে। “প্রথম প্রথম বিরক্ত হতাম। এখন আমিও উৎসাহিত দেই এবং সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। তার অবসর সময়কে সে সামাজিক সচেতনতার কাজে লাগায় সেটা আমারও ভালো লাগে। আগে পাগলামি মনে হলেও এখন সেটা, মনে হয় না। কারণ, অনেক মেয়ে বাল্যবিবাহ থেকে মুক্ত হচ্ছে তার চেষ্টায়।” কামরুন্নাহারের একাডেমি মোনালিসা ওমেন্স স্পোর্টসের সভাপতি মির্জা মাসুদ রুবল বলেন, কামরুন্নাহার সাধারণ জীবন-যাপনের বাইরে ভিন্নভাবে সমাজকে নিয়ে ভাবে। সে মেয়েদের আত্ন-প্রত্যয়ী হতে এবং তাদের শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়া রোধ করতে কাজ করছে। বাল্য বিবাহের মতো সামাজিক সমস্যা রোধে তার এই উদ্যোগ সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা।

সংবাদটি শেয়ার করুন
Share on Facebook
Facebook
Tweet about this on Twitter
Twitter
Email this to someone
email
Print this page
Print
Pin on Pinterest
Pinterest

দৈনিক নবচেতনার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন