জীবিকার তাগিদে স্বজনদের ফেলে জীবনবাজি রেখে কত লোক সাগর পাড়ি দিতে নৌকায় চড়েছে? তাদের মধ্যে পথেই মারা গেছে কতজন? এসব প্রশ্ন এখন ঘুরেফিরে আসছে। থাইল্যান্ডের পর ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়ার উপকূলে উদ্ধার হয়েছে বাংলাদেশী ও মিয়ানমারের হতভাগ্য হাজার হাজার মানুষ।
জানা গেছে,কক্সবাজারের টেকনাফের কয়েকটি নৌকার ঘাট থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী একটি ট্রলার থাইল্যান্ডের উপকূলের কাছে আন্দামান সাগরে ইঞ্জিন বিকল হয়ে তিন সপ্তাহ ধরে ভাসছে এমন খবর পাওয়া গেছে। ট্রলারটিতে প্রায় দুই শতাধিক যাত্রী রয়েছে। এতে ৫০ জন বাংলাদেশী ছাড়া অন্যরা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা নাগরিক।
ট্রলারে থাকা এক যাত্রীর অডিও রেকর্ডে শুনা যায়,ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়া নৌকাটিতে সাগরে চালানোর উপযোগী নয়। গত ১ ডিসেম্বর থেকে তারা সাগরে আছেন। নৌকাটিতে কয়েকদিন আগেই খাবার ও পানীয় জল ফুরিয়ে গেছে। তারা এখন চরম পানিশূন্যতায় ভুগছেন। নৌকায় থাকা নারী ও শিশুদের মধ্যে বেশ আরো কয়েকজন মারা যাওয়ার আশঙ্কার কথা জানান।অনিশ্চিত দূর্ঘটনার আশঙ্কায় যাত্রীদের সবাই কান্নাকাটি শুরু করেছে। ট্রলারে থাকা বাংলাদেশী যুবকদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
মালয়েশিয়াগামী ইঞ্জিন বিকল ট্রলারে থাকা বাংলাদেশীদের অধিকাংশ টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংকছড়ি উপজেলার বাসিন্দা। তাদের পরিবারের দাবি, গত চার সপ্তাহ আগে তাদের সন্তানরা পরিবারের অজান্তে দালালদের প্রলোভনে পড়ে মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে ট্রলারে উঠে পড়ে। তবে দালালদের নাম নিজের মা বাবার কাছেও প্রকাশ করলে পুরো ট্রলার ডুবিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয় ওইসব মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের। তাই তাদের স্বজনরা এখনো দালালদের নাম নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না বা জানলেও ভয়ে প্রকাশ করছেননা।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. জলিল জানান, আমার ছেলে আমিন রানা (২৭) এ মাসের শুরুতে কাউকে কিছু না জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দুই তিনদিন খোঁজাখুঁজির পর বন্ধুবান্ধবদের কাছে খবর পাই, তারা মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ট্রলারে উঠেছে। এরপর গত এক সপ্তাহ আগে মালয়েশিয়ায় থাকা এক আত্মীয়র মাধ্যমে ছেলে খবর পাঠিয়েছে, তাদের বহন করা ট্রলারটি সাগরে ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়েছে।আজ ও কোন দেশ তাদের উদ্ধার করে নাই।এ নিয়ে চিন্তিত।
সরেজমিনে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়া এলাকায় গ্রামে গিয়ে জানা যায়, ওই গ্রামসহ পাশের দরগারছড়া, মিঠাপানিরছড়া, রাজারছড়া গ্রামের প্রায় ৩৫ জন যুবক ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়া মালয়েশিয়াগামী ট্রলারটিতে রয়েছে। নিজেদের সন্তানদের এমন অবস্থা তাদের ঘরে কান্নার রুল পড়েছে। তবে প্রতিবেদকের কাছে ১৩ জনের পরিচয় ও ছবি পৌঁছেছে। তারা হলেন, টেকনাফের হাবির ছড়া এলাকার ছেলে।পুতিয়া মাঝির ছেলে রাশেল (১৭), বাক্কা কুলুর ছেলে হাসিম(১৫), মোঃ মাছনের ছেলে রাশেল (১৯),সুলেমানের ছেলে ইব্রাহিম (২০),নুর ইসলামের ছেলে উসমান গনি (২১),মাছনের ছেলে মিজান(১৮),সামিয়ার ছেলে নুর আলম (২৩),নুর সালামে ছেলে শাহ্ আলম (২২),কবির আহমদের ছেলে আক্তার ফারুক (১৯), মোঃ হালুর ছেলে মিজান (১৬), মোঃ হাসানের ছেলে মোঃ হারুন (২৪), নুর আহমদের ছেলে মোঃ ইউনুছ (২৮) সহ ট্রলারে ভিন্ন জায়গায়র বাংলাদেশী নাগরিক রয়েছে।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর দাবি, মালয়েশিয়াগামী ট্রলারটি প্রায় দুই সপ্তাহ আগে টেকনাফ উপকূল থেকে ছেড়েছে। বর্তমানে ট্রলারের সঙ্গে মালয়েশিয়া থেকে আত্মীয়স্বজনরা স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে কথা বলছেন। সাটেলাইট ফোনে ট্রলার মাঝির দেয়া তথ্যমতে, তারা ভারতের আন্দামান দ্বীপের কাছাকাছি রয়েছে বলে ধারণা । তাদের অদূরে একটি নৌবাহিনীর বড় জাহাজও দেখা গেছে বলে জানায়। তবে ট্রলারের যাত্রীদের বড় আশঙ্কা ও ভয় হচ্ছে খাদ্য ও পানযোগ্য পানির সংকট নিয়ে। তাদের মজুদ থাকা প্রায় খাদ্য ও পানি ইতোমধ্যে পুরিয়ে গেছে বলেও জানায়। তারা এখন তাদের উদ্ধারে কান্নাকাটি করে দেশে মা বাবার কাছে খবর পাঠাচ্ছে।
টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ক”ছপিয়ার বাসিন্দা মোজাহের আলম বলেন, রেজাউল করিম (১৭) নামের আমার এক ছেলেও রয়েছে ইঞ্জিন বিকল হয়ে পড়া ট্রলারটিতে। তারা শুধু আমাদের কাছে কান্না করে খবর পৌঁছিয়েছে, আমরা যেন তাদের ফিরিয়ে আনার দাবি ও হাত জোর করে সরকারের কাছে উদ্ধারের আহ্বান জানাই।
ইউএনএইচসিআর বলেছে, নৌকাটি থেকে লোকজনকে উদ্ধার করে নিরাপদে নামানো না হলে আরও প্রাণহানির আশঙ্কা আছে।তাদের জীবন রক্ষায় কাছাকাছি দেশগুলোর কোন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না উল্লেখ করে উল্লেখ করে সংস্থাটি বলেছে, ইতোমধ্যে ২০ জন মারা গেছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান বলেন, “সাগরে ভাসমান মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে বেশ কিছু বাংলাদেশি রয়েছে এমন খবর স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ তাদের পরিবারের কাছ থেকে শুনেছি। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডকে অবহিত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ট্রলারটি কোন জায়গায় রয়েছে সেটি জানা সম্ভব হয়নি।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মেদ জুবায়ের বলেন, “কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের বেশকিছু রোহিঙ্গা সাগরে ভাসমান ট্রলারে থাকার কথা শুনেছি। মূলত সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে তারা ক্যাম্প ছেড়েছে। কীভাবে তারা সেখানে পৌছেঁছে সে বিষয়ে আমি অবগত নই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দরগারছড়া গ্রামের এক ব্যক্তি বলেন, আমরা আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তার স্বার্থে এখনো দালালদের নাম প্রকাশ করছিনা। এলাকায় মানবপাচারের জড়িত বেশ কয়েকজন দালাল নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা স্থানীয় যুবক ও কিশোরদের কাছে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে কোনভাবে ট্রলারে তুলে দিচ্ছে। তারা যেমন স্বপ্ন নিয়ে সাগর পথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছিল,সেই স্বপ্ন অথৈ সাগরে ভাসছে।
উল্লেখ্য,আরাকান প্রজেক্ট নামের একটি সংস্থার হিসেবে অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ এসব যাত্রায় ২০১৪ সালের অক্টোবর থেকে মারা গেছেন মোট ৫৯০ জন। এদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর নির্যাতনে। অনেকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথাও বলেছেন।এছাড়া ২০১৪ সালে থেকে সমুদ্রপথে বাংলাদেশের উপকূল থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ।