আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর বহু আলোচনা-সমালোচনার পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আলোচিত অরাজনৈতিক সংগঠন ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের’ কেন্দ্রীয় কাউন্সিল (সম্মেলন)।
রোববার হেফাজতের সদর দফতর হিসেবে পরিচিতি চট্টগ্রামের আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা মিলনায়তনে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
এদিন সকাল ১০টা থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষা ভবনে কাউন্সিলের অনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়ে বিকাল ৩টা পর্যন্ত চলবে।
এতে সভাপতিত্ব করবেন আল্লামা শফীর জীবদ্দশায় হেফাজত থেকে পদত্যাগকারী সংগঠনটির সিনিয়র নায়েবে আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী।
এ সম্মেলনে সারা দেশের প্রায় সাড়ে ৩শ’ শীর্ষ নেতা তাদের নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন বাবুনগরী সমর্থক আয়োজকরা। তবে এটিকে কওমি অঙ্গন ও আল্লামা আহমদ শফীর চরম বিরোধী ভাণ্ডারীদের মাধ্যমে হেফাজত দখলের ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেছেন সংগঠনটির প্রয়াত আমীর আল্লামা আহমদ শফীর অনুসারীরা।
শনিবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রয়াত আমীর আল্লামা শফীর অনুসারীরা দাবি করেছেন, সংগঠটির নেতৃত্বে জামায়াত-বিএনপি সমর্থকদের আনার তোড়জোড় চলছে।
এছাড়া শফীপুত্র আনাসপন্থী হেফাজত নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলেও দাবি করেন তারা।
বর্তমানে হেফাজতের কোনো শূরা কমিটি নেই দাবি করে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, সম্মেলনে ৭ জন যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে ৫ জন আমন্ত্রণ পাননি। ৩৫ জন নায়েবে আমীরের মধ্যে ২৩ জন এখনও দাওয়াত পাননি এবং তারা যেন আসতে না পারেন পরিকল্পিতভাবে সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তাছাড়া যিনি সভাপতিত্ব করবেন (মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী) তিনি আগেই পদত্যাগ করেছেন। এরপর আর হেফাজতে ফিরে আসেননি। তাই এ কাউন্সিল অবৈধ।
যদিও তা মানতে নারাজ সম্মেলনের দায়িত্বে থাকা বাবুনগরী ঘনিষ্ঠ হেফাজত নেতারা। শনিবার বিকালে এ ব্যাপারে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী এ বিষয়ে সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, একটি কুচক্রী মহল হেফাজতকে বিতর্কিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। তারাই হেফাজতের আগামীকাল অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিল বানচাল করতে নানা যড়ষন্ত্রে লিপ্ত। তবে তাদের উদ্দেশ্য কোনোদিনও সফল হবে না।
আজিজুল হকের দাবি, ইতোমধ্যে হেফাজতের সব কেন্দ্রীয় নেতাকে সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সবাই সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন বলে আশা করছি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০ বছর এবং হেফাজতের আমীর আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর প্রথমবারের মতো এ কেন্দ্রীয় সম্মেলন ডাকা হয়েছে। এতে প্রয়াত আল্লামা শফীর উত্তরসূরি নির্বাচনের পাশাপাশি হেফাজতের কমিটিতে বড় ধরনের রদবদল হবে।
চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর আমীরের পদটি শূন্য হলে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে প্রস্তুতি নিতে থাকেন ধর্মভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করা দলটির নেতারা।
সম্মেলন বাস্তবায়ন করতে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে তাতে আল্লামা শফীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত নেতাদের রাখা হয়নি। বিপরীতে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী ও বিএনপি-জামায়াত সংশ্লিষ্টদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
সংগঠনটির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হেফাজতের বর্তমান মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী নতুন আমীর এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি নূর হোসাইন কাসেমী মহাসচিব হতে পারেন।
এক্ষেত্রে মহাসচিব হতে হলে কাসেমীকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব পদটি ছাড়তে হবে। কারণ সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কেউ হেফাজতের আমীর বা মহাসচিব হতে পারবেন না।
বিকল্প হিসেবে ঢাকার খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী হতে পারেন হেফাজতের নতুন মহাসচিব।
খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আতাউল্লাহও মহাসচিবের দৌড়ে রয়েছেন। কয়েক দিন আগে এ বিষয়ে হাটহাজারী গিয়ে বাবুনগরীর সঙ্গে দেখা করেছেন তিনি। মহাসচিব না হতে পারলেও ঢাকা মহানগরীর আমীর পদ প্রত্যাশী তিনি। সে ক্ষেত্রে খেলাফত মজলিশের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক তার সেক্রেটারি হতে পারেন।
এদিকে এ কাউন্সিল আল্লামা শফীপুত্র হেফাজতের প্রচার সম্পাদক মাওলানা আনাস মাদানীসহ আরও কয়েকজনকে সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে বর্তমান কমিটির হেফাজতের নায়েবে আমীর মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, মঈনুদ্দীন রুহী, মাওলানা সলিমুল্লাহ ও ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসনাত আমিনীসহ তাদের অনুসারীরা একাধিক পদ থেকে বাদ পড়তে পারেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সংগঠনটির শুরুর দিকে নানা কারণে সরে দাঁড়ানো কওমি অঙ্গনের শীর্ষ বেশ কয়েকজন আলেমকে ফের যুক্ত করা হচ্ছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
এদের মধ্যে পটিয়া আল-জামেয়া আল ইসলামিয়া জমিরিয়া মাদ্রাসার আল্লামা আবদুল হালিম বোখারী, বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক মুফতি আরশাদ রহমানি ও চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফ মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা সুলতান যওক নদভী ও আল্লামা শফীর জ্যেষ্ঠপুত্র মাওলানা মোহাম্মদ ইউসুফ অন্যতম বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কেন্দ্রীয় হেফাজত নেতা বলেন, কওমি অঙ্গন ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ হেফাজতের কাউন্সিলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমাদের একটাই চাওয়া হেফাজত আমীর ও মহাসচিব পদে সবার গ্রহণযোগ্য এবং রাজনৈতিক কোনো অভিলাষ নেই- এমন কাউকে নির্বাচিত করা হোক।
অনুষ্ঠিতব্য হেফাজতের সম্মেলনের সব রকমের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাবুনগরীর আত্মীয় হেফাজতের কেন্দ্রীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য মাওলানা মীর ইদরিস।
তিনি বলেন, আশা করছি সম্মেলন সফল ও সুন্দরভাবে শেষ হবে। এজন্য আমরা সবার সহযোগিতা কামনা করছি। সারা দেশের ৬৪টি জেলার কওমি ও হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতাসহ সব নেতাকর্মীকে সম্মেলনের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
সম্মেলনে কওমি অঙ্গনের ৪০০ জন শীর্ষ মুরব্বি উপস্থিত থাকবেন। তারাই হেফাজতের আমীর নির্ধারণ করবেন।