দেশের জনপ্রিয় কথাশিল্পী ও সাংবাদিক রাহাত খান। কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার জাওয়ার গ্রামের কৃতী সন্তান রাহাত খানের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, কিডনির অসুখসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছেন। সম্প্রতি খাট থেকে নামার সময় পড়ে গিয়ে পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে শয্যাশায়ী হয়ে আছেন।
জুলাই মাসে বারডেমে বেশ কয়েকদিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরলেও চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসা শাস্ত্রে রাহাত খানের জন্য করণীয় কিছু নেই। গেল তিনদিন ধরে শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। শয্যাশায়ী হয়েই দিন কাটছে তার। একদমই চলাচল করতে পারেন না। কথাও বলেন না। অচেতন হয়ে থাকছেন। কেউ ডাকলে তবে সাড়া দেন।
স্বামীর শারীরিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে এমনটাই জানালেন রাহাত খানের স্ত্রী সংগীতশিল্পী অপর্ণা খান।
তিনি বলেন, ‘বারডেমে থাকাকালীনই চিকিৎসকরা বলেছিলেন তাদের কিছু করণীয় নেই। বাসায় নিয়ে আসতে। তবুও আমি দুদিন রেখেছিলাম। কোনো উন্নতি না হওয়ায় বাসাতে নিয়ে এসেছি। অবস্থা ভালো না।’
অপর্ণা খান বলেন, ‘প্রায় ত্রিশ বছর ধরেই তার ডায়াবেটিসের সমস্যা। হার্ট ও কিডনিতেও অনেকদিনের পুরনো সমস্যা। তবুও বয়সের অনুপাতে তিনি বেশ ভালো ছিলেন। চলাফেরা করতেন। নিজে খাবার খেতেন। অফিসেও যেতেন মাঝেমধ্যে। সেদিন হঠাৎ পড়ে গিয়ে রাতারাতি মানুষটা শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। পাঁজরের হাঁড়টি ভেঙে গেছে। অনেক ব্যথা। বারডেমের এম কে আই কাইয়ূম চৌধুরীর অধীনে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন অপারেশন করা লাগতে পারে। কিন্তু উনার শরীরের যে কন্ডিশন তাতে অপারেশন করা খুব ঝুঁকির কাজ হবে।
তাছাড়া অপারেশন করলে হাঁড় জোড়া লাগবে কী না সেটারও নিশ্চয়তা নেই। তাই অপারেশন করা হয়নি। শ্বাসকষ্টের সমস্যা হওয়ায় আইসিইউতে রেখেছিলাম। অবশেষে চিকিৎসকদের কথামতো বাসাতে নিয়ে এসেছি। ২০ দিন ধরে এভাবেই আছে। উন্নতি নেই। বরং অবনতি হয়েছে গেল তিন-চারদিনে। কয়েকদিন আগে পায়ে ব্যথা হতো তীব্র। ব্যথার সময় চিৎকার করেছেন। সেই ব্যথাটাও বোধহয় এখন আর উপলব্দি করতে পারছেন না।
তন্দ্রার মধ্যে আছেন। ডাকলে সাড়া দেন। তখন চেষ্টা করি একটু খাওয়ানোর। খেতেই চান না। একে তো লিকুইড। সেটাও খাচ্ছেন খুবই অল্প পরিমাণে।’
‘তার শারীরিক এই অবস্থায় প্রতিনিয়তই চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে। স্বাচিপের সেক্রেটারি ডা. এম এ আজিজের সঙ্গে কালও কথা বলেছি। আসলে ওষুধে বা চিকিৎসায় কিছু হবার নয় আর। সবার কাছে দোয়া চাই আমার স্বামীর জন্য। তিনি যেন সুস্থ হয়ে উঠেন। আল্লাহ চাইলে সবই সম্ভব’- যোগ করেন অপর্ণা খান।
রাহাত খান ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পূর্ব জাওয়ার গ্রামের খান পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেন। কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমাদৃত হলেও কর্মসূত্রে রাহাত খান আপাদমস্তক সাংবাদিক।
রাহাত খান ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে রাহাত খান কিছুদিন জোট পারচেজ ও বীমা কোম্পানিতে চাকরি করে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে যোগদান করেন। তারপর একে একে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন তিনি।
১৯৬৯ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তার সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি। পরবর্তীতে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় যোগদান করেন। ২০০৯ সাল থেকে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক বর্তমান পত্রিকা। বর্তমানে তিনি দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।
রাহাত খান ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। জনপ্রিয় ও বিখ্যাত থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানার রাহাত খান চরিত্রটি তার অনুসরণেই তৈরি করা।
বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে রাহাত খান কথাশিল্প, ছোটগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও উপন্যাসের নিপুণ কারিগর হয়ে উঠেছেন। ১৯৭২ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ অনিশ্চিত লোকালয় প্রকাশিত হয়। তার পরবর্তী উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অমল ধবল চাকরি, ছায়াদম্পতি, শহর, হে শূন্যতা, হে অনন্তের পাখি, মধ্য মাঠের খোলোয়াড়, এক প্রিয়দর্শিনী, মন্ত্রিসভার পতন, দুই নারী, কোলাহল ইত্যাদি।
ইতিমধ্যেই বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৩), সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৫), সুফী মোতাহার হোসেন পুরস্কার (১৯৭৯), আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮০), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮২), ত্রয়ী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৮) এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় একুশে পদক (১৯৯৬) পেয়েছেন।