চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার অসংখ্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের স্বাস্থ্যসেবার সবচাইতে বড় আশ্রয়স্থল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক)। করোনা মহামারীর এ সময়ে এই হাসপাতাল যেন হয়ে উঠেছে করোনা থেকে বাঁচতে চাওয়া রোগীদের সব চাইতে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল। অথচ এই কঠিন সময়েও হাসপাতালের বিভিন্ন এলাকায় রোগীর সামনেই অবাধে চলছে ধূমপান।
হাসপাতাল এলাকার প্রধান ফটক থেকে শুরু করে জরুরি বিভাগের সামনে, গাড়ি পার্কিং এলাকায়, বিভিন্ন মোড়ে দেদারসে ধূমপান করে যাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। হাসপাতালের চিকিৎসক থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও রোগীর স্বজন এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যকেও হাসপাতালের সামনেই ধূমপান করতে দেখা গেছে। তবে শুধু চমেক হাসপাতালই নয় অন্যান্য হাসপাতালের সামনেও একই চিত্র দেখা গেছে।
গত মার্চে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শুরুর পর মে মাসে চট্টগ্রামের পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হতে শুরু করে। জ্বর, শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করে প্রতিদিনই।
স্যান ফ্র্যানসিসকোর ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা জানিয়েছেন, অধূমপায়ীদের তুলনায় করোনা ভাইরাসের ধূমপায়ীদের আক্রান্ত হওয়ার ও মৃত্যুঝুঁকি ১৪ গুণ বেশি। করোনা মহামারী শুরুর পর থেকেই ডব্লিউ এইচ ও থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা ধূমপান থেকে বিরত থাকবার পরামর্শ দিয়েছেন।
চমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, হাসপাতাল এলাকায় ধূমপানের বিষয়ে আমাদের আগে থেকে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। মাঝখানে করোনার জন্য এ অভিযান বন্ধ থাকলেও আবার পরিচালনা করা হবে। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য অনেকে আসে তারা ধূমপানের শিকার হয় বিষয়টি দুঃখজনক।
ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, করোনা কালীন ধূমপান করলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য। যা হৃদপিণ্ডকে দুর্বল করে দেয়। এছাড়া ধূমপান যে করে সে নিজে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হয় তেমনি তার কারণে আরেক জন পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। হাসপাতালের কর্মচারীদেরকে অনেক মোটিভেশন করা হয়েছে যেন ধূমপান না করে। এতে অনেকাংশ কমে এসে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) কোভিড আইসোলেশন সেন্টারের পরিচালক ডা. সুশান্ত বড়ুয়া ব্রেকিংনিউজকে বলেন, নিয়মিত ধূমপান করলে শ্বাসতন্ত্রের উপরের অংশে যে ছোট ছোট চুলের মতো সিলিয়া থাকে, যাদের কাজ ধুলোবালি, জীবাণুকে বার করে ফুসফুসকে সুস্থ রাখা, তারা কিছুটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে বলে যে কোনও ধরনের সংক্রমণই হুট করে ঢুকে পড়ে। ফলে নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টিবি-র পাশাপাশি বাড়ে কোভিডেরও আশঙ্কা।’
তিনি বলেন, ধূমপানের ফলে শুধু ধূমপায়ীরাই নয় অধূমপায়ীরাও করোনা ভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। এর কারণ ধূমপায়ী যদি সংক্রমিত হন, তিনি যখন ধোঁয়া ছাড়েন, সেই ধোঁয়ায় ভর করে ভাইরাসও ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। ওই অ্যারোসল বা বাতাস বাহিত লালার কণায় ভাইরাস বেঁচে থাকতে পারে প্রায় ঘণ্টা তিনেক। কাজেই বদ্ধ ঘরে কাছাকাছি বসে বা দাঁড়িয়ে ধূমপান করলে খুব দ্রুত অন্যের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে, যাকে বলে ক্লাস্টার ইনফেকশন।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পরোক্ষ ধূমপানের হার ব্যাপক। সেন্ট্রাল ফর ডিসিস কনট্রোল (সিডিসি)-যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কারিগরী সহায়তায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত এ জরিপের বিভাগভিত্তিক ফলাফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, চট্টগ্রাম বিভাগে বিভিন্ন পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হচ্ছেন। ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ সরকারি অফিসে, ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ বিদ্যালয়ে, ২০ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে, ৫৮ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ রেস্টুরেন্টে এবং ৬৩ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ গণপরিবহণে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য সংগঠন ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যালএ্যাকশন (ইপসা) এর জরিপে দেখা যায়, চট্টগ্রাম নগরে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের চিত্র দেখা গেছে সরকারি অফিসে ৯৯ শতাংশ, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে ৯৭ শতাংশ, রেস্টুরেন্টে ৯৯ শতাংশ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০০ শতাংশ এবং গণপরিবহনে শতভাগ।
এ বিষয়ে ইপসার উপ পরিচালক নাছিম বানু ব্রেকিংনিউজকে বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী হাসপাতালসহ সকল পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ এবং এর জন্য জরিমানার বিধানও রয়েছে। শুধু প্রাপ্তবয়স্করাই নয়, তামাকের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের তরুণ প্রজন্মও। দেশে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৬০ জন মানুষ মারা যায়। করোনা মহামারীর এই সময়ে এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলায় বাহুল্য। প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের জোরালো উদ্যোগ ছাড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি সম্ভব নয়। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়ন করলে চট্টগ্রামবাসী পরোক্ষ ধূমপানের হাত থেকে রক্ষা পাবে এবং একটি সুস্থ সবল প্রজন্ম গড়ে উঠবে।