বগুড়ায় ছন ও তালপাতা দিয়ে তৈরি হচ্ছে ঝুড়ি, বাটি, ডালা, কড়াই, ট্রে ও পাটিসহ বিভিন্ন নান্দনিক নিত্যব্যবহার্য বস্তু এতে তৈরির কাজ করছে ৩৫টি গ্রামে ৮ হাজার নারী। গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহৃত এসব রকমারি পণ্য তৈরি করে অভাব দূর করার পাশাপাশি তারা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন। তাদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় ছন ও তালপাতার রকমারি এসব পণ্য এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ, আমেরিকাসহ ধনী দেশগুলোতে বেশ চাহিদা করে নিয়েছে। যা থেকে আসছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা।
৩০ জুলাই শেরপুর উপজেলার গাড়ীদহ ইউনিয়নের হাপুনিয়াসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ছন-তালপাতা আর সুই দিয়ে রকমারি পণ্য তৈরি করছেন নারীরা। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নারীরা ছন-তালপাতা আর সুই দিয়ে ঝুড়ি, বাটি, ডালা, কড়াই, ট্রে ও পাটি ও শোপিসসহ বিভিন্ন নান্দনিক রকমারি পণ্য তৈরি করছেন নারীরা। কোথাও বা বসেছেন এলোমেলোভাবে। অনেক জায়গায় গোল করে বসে একমনে কাজ করে যাচ্ছে তারা। প্রত্যেকের হাতেই শোভা পাচ্ছিলো তালপাতা, ছন আর সুঁই। এই তিনের মিলিত বন্ধনেই তৈরি করছিলেন রকমারি পণ্য। কোথাও আবার তৈরি পণ্যগুলো শুকানোর কাজ করছিলেন কেউ কেউ। হস্তশিল্পের এই কাজটি করে থাকেন নারীরা। এক্ষেত্রে পুরুষেরা অনেকটা সহায়কের ভূমিকা পালন করেন। বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরের গ্রাম শেরুয়া ও ধড়মোকাম থেকে শৌখিন এ হস্তশিল্প তৈরির কর্মযজ্ঞ এখন ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার গাড়ীদহ, শাহ বন্দেগী, কুসুম্বি, খানপুর, বিলাশপুরসহ ৮টি ইউনিয়নের ৩৫টি গ্রামে। ধীরে ধীরে ৭ থেকে ৮ হাজার নারী জড়িয়ে পড়েন হস্তশিল্প তৈরির এই কর্মযজ্ঞে। তাদের হাতে তৈরি এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। উল্লেখ্য ঢাকা থেকে আসা একজন ব্যবসায়ী ১৯৮৫ সালে নারীদের হাতে তুলে দেন কাশফুলের খড়, ছন ও তালপাতা। সেখান থেকেই শুরু হয় ডালা-ঝুড়ির মতো শৌখিন হস্ত শিল্প তৈরি। দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামজুড়ে শুরু হয়ে যায় এ হস্ত শিল্প। নারীদের তৈরি করা এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি শুরু করেন ঢাকা থেকে আসা ওই ব্যবসায়ী। ১৯৯০ সাল থেকে ডালা (ছন ও তালপাতার তৈরি) হস্তশিল্পের প্রসার ঘটতে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে ক্লাসিকাল হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট প্রোডাক্ট বিডি লি.আস্ক হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট, ঢাকা হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট, সান ট্রেড হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট, কনেস্পো হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট নামে বেশ কয়েকটি বেসরকারি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা এ শিল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। নারীদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য প্রতিটি গ্রামে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর এজেন্ট রয়েছে। সেই সঙ্গে ১৫ থেকে ২০০ জন নিয়ে গঠিত হয় সমিতি। সমিতির নারী সদস্যরা তাদের দলপ্রধানের মাধ্যমে পণ্য দেন এজেন্টের কাছে। অনেক নারী এজেন্টদের কাছ থেকে হস্তশিল্পী তালপাতা, ছন এবং পাটের সুতাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল সংগ্রহ করেন। তা দিয়ে চাহিদামতো জিনিস তৈরি করে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতেই সরবরাহ করেন। অনেকে পণ্য বিক্রির পর কাঁচামালের অর্থ ফেরত দেন। আর এতে করে অতিরিক্ত মূলধনেরও প্রয়োজন হয় না এসব নারীদের। এর মাধ্যমে এসব নারী অর্থনৈতিকভাবেও সাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। কয়েকজন কারিগর জানান, ঝুড়ি তৈরির কাঁচামাল তালপাতার উপকরণ আসে পাশের দুপচাঁচিয়া, কাহালু উপজেলা থেকে। ছন আসে বগুড়ার ধুনট, সারিয়াকান্দি ও সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলার যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চল থেকে। পণ্য তৈরিতে প্রথমে তালগাছের পাতা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আঁশ বের করা হয়। এ আঁশ দেখতে ঠিক বেতের মতো। এছাড়া হোগলাপাতা ও কাশফুলের গাছ শুকিয়ে ঝুড়ি তৈরির কাঁচামাল প্রস্তুত করা হয়। পরে তালপাতার শুকনা আঁশ, হোগলাপাতা আর কাশফুলের উল বা প্লস্টিকের দড়ি দিয়ে হাতে বুনে ঝুড়ি তৈরি করা হয়। তারা জানান, কষ্ট করে পণ্য তৈরির কাজটা তারাই করেন। কিন্তু মোটা অঙ্কের লাভ চলে যায় স্থানীয় এজেন্টদের হাতে। তালপাতার একটি ঝুড়ি ও লন্ডি ঝুড়ি তাদের কাছ থেকে আঁকার ভেদে ২০০ থেকে ৪৫০ টাকায় কিনে এজেন্টরা ৪০০ থেকে ৬৫০ টাকায় রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রি করেন। বিড়াল-কুকুরের ঝুড়ি ১৩০ থেকে ১৬০ টাকায় এজেন্টদের কাছে বিক্রি করেন তারা। এজেন্টরা ২৩০-২৭০ টাকায় বিক্রি করেন।সংসারের কাজের পাশাপাশি তাদের গ্রামের ৯৫ ভাগ মহিলারাই এই কাজের সঙ্গে জড়িত। এখানের মহিলারা ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরির জন্য যায় না। গ্রামেই কাজের সুযোগ রয়েছে। নারীরা এ পেশায় নিয়োজিত হওয়ায় তাদের সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরছে। গাড়ীদহ ইউনিয়নের মহিপুর কলোনি এলাকার ভাই-বোন হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট এর স্বত্বাধিকারী মো: ইউনুস আলী বলেন, গ্রামের ১৫ থেকে ২০ জন নারীকে নিয়ে ছোট একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছি। মূলত ক্লাসিকাল হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট প্রোডাক্ট বিডি লি. নামে বড় একটি প্রতিষ্ঠানে আমার পণ্যগুলো সরবরাহ হয়ে থাকে। ওই প্রতিষ্ঠানসহ শেরপুরের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে চাহিদা মোতাবেক নানান ডিজাইনের ডালা অর্থাৎ ঝুড়ি তৈরির অর্ডার নেই। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্ধারিত ডিজাইন, তালপাতা ও ছন দিয়ে থাকি। তিনি বলেন, আকার ও আকৃতি অনুসারে এ ঝুড়িগুলো উন্নত দেশে পোষা প্রাণীর জন্যও ব্যবহার করা হয়। সাধারণত উন্নত জাতের বিড়াল, কুকুরসহ আরও অন্যান্য প্রাণীদের জন্য এটি অত্যান্ত উপযোগী ও আরামদায়ক হওয়ায় বিদেশে এর চাহিদা অনেক। ব্যবসায়ীরা জানান, হাতে তৈরি এসব ঝুড়ি স্থানীয়ভাবে তৈরি হলেও বিদেশে এ পণ্যের কদর অনেক বেশি। বাংলাদেশের মধ্যে বগুড়ার শেরপুরে এ ধরনের ঝুড়ি সবচেয়ে বেশি বানানো হয়। অন্য জেলাতেও কিছু তৈরি হয়। তবে বগুড়ার পণ্যের মান ভালো হওয়ায় চাহিদাও বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত দেশগুলো এ পণ্যের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখায়। পরিবেশ সম্মত এ পণ্য আগামীতে আরও বেশি করে চাহিদা বাড়বে।