ঢাকার সাভারে গত ১৯ আগস্ট নিহত গোলাম কিবরিয়া নামক শিক্ষককে হত্যার পর চিরকুট লিখে ফেলে রাখার রহস্য উদঘাটন ও হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী সহ জড়িত ৩ জনকে যশোর, ঝিনাইদহ ও রংপুর থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। পাশাপাশি, হত্যাকান্ডের পর লুটকৃত ৫ লক্ষাধিক টাকাও উদ্ধার করা হয়েছে। মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। গ্রেফতার আসামীগণ হলেন- হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মোঃ ইমন খান (২৩), পিতা আশরাফ হোসেন, চৌগাছা, যশোর ও মোঃ সাগর (২২), পিতা আব্দুল হাকিম, মিঠাপুকুর, রংপুর এবং তাদের সহযোগী মোঃ ছাদেক গাজী (২২), পিতা মোঃ ইমতিয়াজ গাজী, ঝিনাইদহদ। প্রসঙ্গত, গত ২০ আগস্ট ২০২৩ তারিখ আনুমানিক ৩টার দিকে সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটপাড়া এলাকায় নিজ বাড়ির কক্ষ থেকে হাত-পা বাঁধা এবং গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় গোলাম কিবরিয়া (৪৩) নামের সাবেক এক স্কুল শিক্ষকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ সময় মরদেহের পাশ থেকে ‘এই ব্যক্তি সমকামী করে পুলিশ ভাই, আমরা তাই মেরে ফেলেছি, ভাই ও অবৈধ কাজ করে। আমরা ইসলামের সৈনিক’ লেখা সম্বলিত একটি চিরকুট পাওয়া যায়। এই ঘটনায় ভিকটিমের ভাই বাদী হয়ে সাভার মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা (নং-৬২/৬৬৯, তারিখ ২১ আগস্ট ২০২৩) দায়ের করেন। সাংবাদিকদের কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, হত্যাকান্ডটি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত হলে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচিত হয়। র্যাব উক্ত হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব-৪, ৬ ও ১৩ এর একটি আভিযানিক দল যশোর, ঝিনাইদহ ও রংপুর এলাকায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করে উক্ত হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী সহ মোট ৩ জনকে গ্রেফতার করে। এসময় উদ্ধার করা হয় লুটকৃত ৫ লক্ষ ২১ হাজার ৯৯ টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা ভিকটিম গোলাম কিবরিয়াকে হত্যার বিষয়ে তথ্য প্রদান করেছে। তিনি আরও বলেন, স্থানীয়সূত্রে জানা যায় যে, ভিকটিম গোলাম কিবরিয়া সাভার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটপাড়া এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন। তিনি বিগত কয়েক বছর ধরে নিজ বাড়ীতে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন। পাশাপাশি জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করতেন। গত ১৯ আগস্ট ২০২৩ তারিখ রাত আনুমানিক ১০টার সময় তার বড় ভাই মোঃ গোলাম মোস্তফার ঘরে রাতের খাবার শেষে নিজ কক্ষে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘটনার দিন ২০ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে ভিকটিম ঘুম থেকে না উঠায় ভিকটিমের বাড়ীর লোকজন তাকে ডাকাডাকি করে। ভিকটিমের বাড়ির লোকজন ঘরের ভিতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে একপর্যায়ে ভিকটিমের ঘরের পেছনের দরজা খোলা দেখতে পায়। এ সময় ভিকটিমের বাড়ির লোকজন রুমের ভিতর গিয়ে খাটের উপর লুঙ্গি দিয়ে ভিকটিমের হাত-পা বাধা ও গলায় গামছা পেঁচানো অবস্থায় ভিকটিমের নিথর মৃতদেহ দেখতে পায়। এছাড়াও ভিকটিমের রুমের মালামাল এলোমেলো এবং আলমারী খোলা অবস্থায় ছিল। হত্যার মোটিভ সম্পর্কে সাংবাদিকদের র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত ইমনের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে এই হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয়। গ্রেফতারকৃত সাগর একজন অটো রিক্সা চালক হওয়ায় ভিকটিম তার অটো রিক্সায় মাঝে মধ্যে যাতায়াত করার কারণে ২ বছর পূর্বে ভিকটিমের সাথে তার পরিচয় এবং সু-সম্পর্ক তৈরি হয়। পরবর্তীতে বিগত ৬ মাস পূর্বে গ্রেফতারকৃত সাগর তার বন্ধু ইমনকে ভিকটিমের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরিচয়ের সুবাধে গ্রেফতারকৃত ইমন ও সাগর ভিকটিমের বাসায় মাঝে মধ্যে যাওয়া আসা করতো। ভিকটিম গোলাম কিবরিয়া জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা করতেন এবং ব্যবসার যাবতীয় টাকা বাসায় রাখতেন বলে জানা যায়। গ্রেফতারকৃত সাগর ও গ্রেফতারকৃত ইমন ভিকটিমের বাসায় যাওয়া আসার সুবাধে ভিকটিমের আলমারীতে রাখা জমি ক্রয়-বিক্রয়ের বিপুল পরিমান টাকা তাদের নজরে আসে। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত ইমন ও সাগর ভিকটিমকে হত্যা করে তার টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে। গ্রেফতারকৃত ইমন পরিকল্পনার বিষয়টি ঘটনার ৭-৮ দিন পূর্বে তার বন্ধু গ্রেফতারকৃত ছাদেক’কে জানায় এবং গ্রেফতারকৃত ছাদেকের বিভিন্ন জায়গায় ঋণ থাকায় সে এই পরিকল্পনায় সম্মতি দেয়। তিনি বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার দিন (১৯ আগস্ট) গ্রেফতারকৃত ইমন ও ছাদেক জিরানী বাজার থেকে বাস যোগে সাভারের বাসষ্ট্যান্ড এলাকায় এসে গ্রেফতারকৃত ইমন ভিকটিমকে ফোন করে তার সাথে দেখা করতে চাইলে ভিকটিম তাদেরকে বাসায় আসতে বলে। আনুমানিক রাত ১০.৪৫ মিনিটে গ্রেফতারকৃত ইমন ও ছাদেক ভিকটিমের বাসায় আসে। এ সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী সাগর অটোরিক্সা নিয়ে ভিকটিমের বাসার আশেপাশে অবস্থান করে। ভিকটিমের বাসায় তারা রাতের হালকা নাস্তা শেষে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টার সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে গ্রেফতারকৃত ছাদেক ভিকটিমের গলা চেপে ধরে এবং গ্রেফতারকৃত ইমন ভিকটিমের মুখ চেপে ধরে। পরবর্তীতে তারা কৌশলে ভিকটিমের লুঙ্গী দিয়ে হাত-পা বেঁধে ও গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে ভিকটিমের মৃত্যু নিশ্চিত করে।