ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের হিড়িক পড়েছে। গত ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের পর এই মামলার হিড়িক পড়ে। এসব মামলা নিয়ে বানিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। এতে করে জনমনে বিরাজ করছে মামলা আতঙ্ক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ ই আগষ্ট সরকার পতনের পর জেলার বিভিন্ন থানায় ২৯ টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামী করা হয়েছে ১৯২৯ জনকে। প্রত্যেক মামলায় আরো এক-দেড়শো জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী রয়েছে। এছাড়া আদালতেও হয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা। এসব মামলার আসামী হচ্ছেন প্রতিপক্ষের রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক ও ব্যবসায়ী। আসামীর তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়নি সাংবাদিকদেরও। এ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬/৭ জন সাংবাদিককে আসামী করা হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী মামলা হয়েছে সদর মডেল থানায় ১৩ টি। অন্য থানার মধ্যে আখাউড়ায় ৫ টি, আশুগঞ্জে ৪ টি,নবীনগরে ২টি এবং সরাইল, নাসিরনগর, বাঞ্ছারামপুর, কসবা ও বিজয়নগর থানায় ১ টি করে মামলা হয়েছে। এসব মামলার বেশীরভাগই হত্যার অভিযোগে করা হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে বিষ্ফোরক ও নাশকতার মামলা। প্রতিটি মামলায় আড়াইশ, সাড়ে তিনশ কিংবা পাঁচশ থেকে সাতশত জনকে আসামী করা হচ্ছে। প্রতিটি মামলা হওয়ার ২/৩ দিন আগ থেকেই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে মামলার খবর। পাশাপাশি মামলার ড্রাফটকরা কপি ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসআপ বা অন্য কোন অনলাইন মাধ্যমে। এরপরই আসে মামলা থেকে নাম বাদ দিতে টাকার প্রস্তাব। রফাদফা হলেই মুক্তি। প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে বানিজ্যের সুবিধার্থে প্রাথমিকভাবে বিত্তশালীদের নাম দিয়েই সাজানো হয় মামলার খসড়া আসামী তালিকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মামলা বানিজ্যের এই অভিযোগ এখন ব্যাপক আলোচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তÍর লেখালেখি হচ্ছে। পুলিশ বলছে মামলা বানিজ্যের সাথে যারা জড়িত তাদের ধরার চেষ্টা চলছে। এনিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্কতামুলক বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে। থানায় মামলা না করেও মামলার কথিত বাদী হয়েছেন শহরের দক্ষিন মৌড়াইলের ওষুধ ব্যবসায়ী মোঃ মোবারক হোসেন। দক্ষিন মৌড়াইলের ওষুধ ব্যবসায়ী মোঃ মোবারক হোসেনকে বাদী বানিয়ে তৈরী করা একটি মামলার এজাহারের খসড়া কপি গত মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ায়। এবিষয়ে গত ৩১শে অক্টোবর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেন মোবারক। যাতে তাকে বাদী দেখিয়ে মামলার ভুয়া এজাহার তৈরী করে হোয়াটসআপ-ফেসবুকে দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। মোবারক হোসেন জানান-মামলার কপি ভাইরাল হওয়ার পরই তার ছোট ভাই মোকাররম হোসেন রবিন ফোন করে মামলার বিষয়টি সত্য কিনা তার কাছে জানতে চান। আমি কোন কিছু জানিনা বলে তাকে জানাই এবং নিরাপত্তার জন্যে আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করি। এটি কেন করা হয়েছে তা বুঝতে পারছিনা। শত্রুতামূলক কেউ করে থাকতে পারে। গত ২৮ শে অক্টোবর সাড়ে ৩ শত জনের বিরুদ্ধে সদর মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এর আগে থেকেই অনলাইনে ভেসে বেড়াচ্ছিলো এই মামলার কপি। নাম প্রকাশ না করে এক ব্যবসায়ী জানান-তিনি ওই মামলার ৫ রকম আসামী তালিকা পেয়েছেন। দেখা গেছে একটিতে কারো নাম আছে,অন্যটিতে নেই। আসামীদের নামও আগে পিছে করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষকদল যুক্তরাজ্য শাখার সদস্য সচিব ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জাতীয়তাবাদী ফোরাম ইউকে’র আহবায়ক শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহিম মিয়া বলেন- এই মামলাটি হওয়ার ৩ দিন আগে অনলাইনে ৩০০ জনের নামে মামলা হচ্ছে মর্মে একটি এজাহারের কপি পাই। আমার ছোট ভাই শাহ মোহাম্মদ ইয়াছিন মামলার কপিটা হোয়াটসআপে আমাকে পাঠায়। পরে দেখলাম থানায় রেকর্ডকৃত মামলায় আমার দুই ভাই ইয়াছিন ও কাওসারের নাম যথাক্রমে ২৯ ও ৩০ নম্বরে রয়েছে। অথচ আমার পুরো পরিবার বিএনপি’র রাজনীতিতে যুক্ত। মামলার কপি পাওয়ার পরই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিএনপি নেতাদের সাথে কথা বলি। জেলা শহরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা ইব্রাহিম আরো বলেন-এই শহরে কে আওয়ামীলীগ আর কে বিএনপি-এটা চিহ্নিত। যেসব মামলা হচ্ছে, আমার জানামতে আসামীদের ২০ ভাগও ঘটনার সাথে জড়িত নয়। সম্প্রতি আরো একটি মামলা ফেসবুক-হোয়াটসআপ ম্যাসেঞ্জারে ঘুরছে। সেই সাথে বানিজ্যের কথাবার্তাও হচ্ছে। আলোচনা আছে শহরের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে দুটি মামলা থেকে তার নাম বাদ দেয়ার জন্যে ২৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়। আরেক জনের কাছে ১৫ লাখ টাকা। মামলা থেকে বাঁচতে কেউ কেউ ২/৩ লাখ টাকা করে দিয়েছেন এমন তথ্যও চাউর আছে। নাম কাটার জন্যে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। মামলায় আসামী করার ভয় দেখিয়েও অনেকের কাছে টাকা চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে জেলা শহর থেকে গ্রামের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ নিয়ে ভয়ে কেউ মুখ খুলছেননা। মামলা বানিজ্য চরমে উঠার পর গত ২৯ শে অক্টোবর সদর মডেল থানা পুলিশ একটি সতর্ক বিজ্ঞপ্তি দেয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোজাফফর হোসেন স্বাক্ষরিত এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কতিপয় ব্যক্তি কম্পিউটার টাইপের মাধ্যমে ২০০/৩০০ বা তার অধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ পূর্বক মামলার অভিযোগ/এজাহার লিখে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। মামলায় তাদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া ও মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলে টাকা-পয়সা আদায় সহ জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এরূপ এজাহার বা অভিযোগ দেখে কেউ আতঙ্কিত বা ভয় পেয়ে কোন প্রকার টাকা পয়সা লেনদেন না করার জন্যে সতর্ক করার পাশাপাশি এমন এজাহার বা অভিযোগ দেখলে আতঙ্কিত না হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় যোগাযোগ করতে বলা হয়। মামলা বানিজ্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। জেলা হেফাজত ইসলাম নেতা মুফতী জাকারিয়া খাঁন বলেন, যারা মামলার নামে ফায়দা হাসিল করছে তাদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়। জেলা জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসেন সাংবাদিকদের জানান,গত ৫ ই আগষ্টের পর আমরা সুন্দর পরিবেশেই বসবাস করছিলাম। এখন দেখা যাচ্ছে মামলাকে পুঁজি করে বানিজ্য করছে। এটা দুঃখজনক। একজন ব্যক্তি হত্যা হয়েছে বা কোন ঘটনার শিকার হয়েছে। এখানে ৩৫০জন, আড়াইশো বা ৫’শ লোক আসামী হওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। এ ব্যাপারে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি কামরুজ্জামান মামুন বলেন-মামলা ফাইল হওয়ার আগে অনলাইনে দিয়ে বা লিষ্ট দেখিয়ে যে বানিজ্য করা হচ্ছে তা অনৈতিক। এনিয়ে আমি খুবই বিব্রত। এধরনের হয়রানীর শিকার কেউ হোক আমি চাইনা। যারা এটা করছি এদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সিরাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন-ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইদানিং কালে কিছু মামলার কপি ঘুরে ফিরে বিভিন্ন আইডিতে পোষ্ট করা হচ্ছে। এসব কপি ফেসবুকে দিয়ে কেউ কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছে। এতে বিএনপি জড়িত নয়। আমি নিজেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পাই, কিছু মানুষ মামলা বানিজ্যের জন্যে কারো কারো নাম লিষ্ট করে পোষ্ট করছে। এনিয়ে অনেক মানুষ আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমি ওসি এবং পুলিশ সুপারকে বিষয়টি অবগত করে অনুরোধ করেছি এব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহন করতে। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাবেদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন-বিষয়টি জানার পর থেকে আমরা বিভিন্ন জায়গায় রেইড দিয়েছি। আমি ওসিকে বলেছি যেহেতু টাইপ হয়,কম্পিউটার আকারে অনলাইনে যাচ্ছে সেজন্যে কম্পিউটারের দোকানগুলোতে রেইড দিতে বলেছি। এজন্যে আমাদের কম্পিউটার এক্সপাটদের নিয়ে যেতে বলেছি। তারা গিয়ে কম্পিউটারে সার্চ করে দেখবে। তাদের সেইভ ফাইলে এধরনের কোন কিছু আছে কিনা। বাজার কেন্দ্রিক আমরা কিছু পাইনি। পরবর্তী সন্দেহ কোর্ট ভিত্তিক। এজাহার লেখার জন্যে অভিজ্ঞতার দরকার পড়ে। যারা এর সাথে সংশ্লিষ্ট তারা। আমরা ওই জায়গায় হাত দেবো আমরা এনিয়ে গোপনে কাজ করছি। যেই হোক এটা অন্যায় জিনিস। এটাকে অবশ্যই নিবৃত্ত করতে হবে। আমি এটা করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। যে জড়িত থাকবে তাকে ছাড় দেবনা।