বে অব বেঙ্গল কনভারসেশনে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্বোধনী ভাষণ নিচে তুলে ধরা হলো:
বন্ধুগণ, বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অংশগ্রহণকারীগণ, ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়াবৃন্দ:
আজকে রাতে এখানে এমন একটি শহরে যেটি সবেমাত্র একশ দিন আগে একটি অনন্য রাজনৈতিক অভ্যুত্থান দেখেছে, সেখানে আপনাদের সাথে থাকতে পারা একটি সত্যিকারের আনন্দের বিষয়। এটি ছিল গত ষোল বছর ধরে দেশ শাসন করা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটাতে ছাত্রদের নেতৃত্বে এক বিপ্লব।
আমি একটি সদ্য উদীয়মান দেশে- এটি যে নিজেকে নতুন বাংলাদেশ বলে অভিহিত করে পুরানো বাংলাদেশ থেকে দূরত্ব স্থাপন করতে চায় তা তুলে ধরতে- আমাদের আন্তর্জাতিক অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছি।
একশ’ দিন আগে প্রায় ১,৫০০ ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারণ বিক্ষোভকারী সাবেক শাসক গোষ্ঠীর হাতে নিহত হয়, আহত হয় প্রায় ২০ হাজার মানুষ। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে আসুন, যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা সারা জীবনের জন্য তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চোখ হারিয়েছেন, আর যারা শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে এখন জীবনের সাথে লড়াই করছেন, তাদের সকলকে শ্রদ্ধা জানাই।
বিদেশি অতিথিবৃন্দ, আমি আপনাদের ঢাকার রাস্তায় পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখার একটি ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া না করার এবং হত্যাকাণ্ড স্তিমিত থাকার সময় তরুণদের আবেগ-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে রঙিন চিত্র আঁকা রাস্তার দেয়ালগুলো দেখার অনুরোধ করছি। হত্যার স্থানগুলোতে তরুণদের অভিব্যক্তির শক্তি দেখে কেউ অবাক না হয়ে পারবেন না। কোনো ডিজাইনার ছিল না, কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ছিল না। আর কোনো সংস্থা এতে অর্থায়নও করেনি।
আমি এই বছরের বঙ্গোপসাগর কনভেনশনের উদ্বোধন করতে পেরে সৌভাগ্যবান বোধ করছি। আমি বিশেষ করে নানা ধ্যান-ধারণা ও স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা বাস্তবে রূপ নিতে পারে এমন এক সময়ে এই সমাবেশের আয়োজন করার জন্য সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
এই সম্মেলন শুধু মনের মিলের চেয়েও বেশি কিছু; এটা আমাদের অভিন্ন প্রাণশক্তির প্রমাণ। বাংলাদেশ সবসময়ই স্বপ্ন, শ্রম ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির লীলাভূমি। মনে বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা সতেজ থাকায় এখন তা আরও বেশি।
এটি লাখো কণ্ঠস্বরের কাজ, প্রায় গোটা জাতির কণ্ঠস্বর, এমন কণ্ঠস্বর যা পরিবর্তনের দাবি তুলেছে, সেই কণ্ঠস্বর যা আমাদের সকলকে মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও অন্তর্ভুক্তির ওপর ভিত্তি করে একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার তাগিদ দেয়।
সম্মেলনের এ বছরের প্রতিপাদ্য, ‘একটি চিড়-ধরা বিশ্ব’ আমার সাথে গভীরভাবে অনুরণিত হয়। আমরা চ্যালেঞ্জ ও নানা জটিলতা-চিহ্নিত সময়ে বাস করছি। এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার, বা জলবায়ু পরিবর্তন, যেই হুমকিই হোক, আমরা নানা অপ্রতিরোধ্য বিষয়ের সম্মুখীন। আর তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে, আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি সম্পর্কে, প্রতিকূলতার সম্মুখীন হওয়া এবং এর থেকে সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে কিছু জানি।
এটি এমন এক শিক্ষা যা আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েক দশক আগে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কাজ করে, তাদের সাহস দেখে এবং তাদের শক্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শিখেছি। এটি সেই অভিজ্ঞতা যা আমাকে শিখিয়েছে যে যদি আমাদের ধৈর্য থাকে, চেষ্টা করার সাহস থাকে এবং এগিয়ে যাওয়ার অধ্যবসায় থাকে, তাহলে প্রতিটি সমস্যার অন্তত একটি সমাধান থাকে।
আমরা জানি আপনাদের বিনা দোষে কঠোর শাস্তি পেতে হয়েছে, আমাদের নিজেদের থেকে অনেক বড় শক্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে, যখন আমরা একাট্টা হই, যখন আমরা এক জোট কাজ করি, তখন আমাদের ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করার ক্ষমতা অর্জিত হয়, যেমনটি আমরা ১০০ দিন আগে বাংলাদেশে করেছি। এই কনভেনশনটি ঠিক তা নিয়ে- ঐক্যের শক্তি, অভিন্ন উদ্দেশ্যের শক্তি নিয়ে।
আমাদের অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের শিকার দেশগুলোর সম্মুখ সারিতে রয়েছে। প্রতি বছর আমাদের উপকূলীয় জনগোষ্ঠী সমুদ্রপৃষ্ঠের বর্ধমান উচ্চতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন হয়, যা জীবন, আবাসস্থল ও জীবিকায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এই সংকট এমন কিছু নয় যা অন্য দিনের জন্য স্থগিত রাখা যায়; এটি এমন কিছু যার জন্য আমাদের অবিলম্বে ও ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপের প্রয়োজন।
একই সাথে, আমরা অপার সম্ভাবনার একটি অঞ্চল। আমাদের দেশ, তরুণদের দেশ। ১৭১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ২৭ বছরের কম। এটি একটি বিরাট শক্তি! এটি দেশকে সৃজনশীলতায় অনেক শক্তিশালী করে তোলে। আমাদের তরুণদের শক্তি আছে বিশ্বকে টেকসই উন্নয়নে নেতৃত্ব দেওয়ার, আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা ও উন্নয়নে সবুজ প্রবৃদ্ধির মডেল তৈরি করার। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সহযোগিতা, সাহস ও আমাদের অভিন্ন ভবিষ্যতের অটল বিশ্বাস।
আগামী কয়েকদিনের এই সমাবেশে আমরা বিতর্ক করব এবং আমাদের চিন্তাভাবনা শেয়ার করব- এমন এক সময় আমি আপনাদের একটি নতুন বিশ্ব গড়তে উৎসাহিত করছি। আমাদের তরুণরা আমাদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে নিয়ে গেছে।
আসুন একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করি, একে অপরের কথা শুনি এবং পরিবেশগতভাবে নিরাপদ গ্রহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি নতুন জীবনধারা গড়ে তুলে একটি নতুন বিশ্বের স্বপ্ন দেখার সাহস সঞ্চয় করি। এবং এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলি, যেখানে প্রযুক্তির সুফল ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সকলে সমানভাবে ভাগাভাগি করে নেবে; বিশেষ সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয় মানুষ একচেটিয়াভাবে নিয়ে যাবে না।
আমি সবসময় অবশ্যাম্ভাবীভাবে আশাবাদী। আমি সবসময় ধারণার শক্তি, স্বপ্নের শক্তিতে আস্থাবান। আমি জোর দিয়ে বলি যে আমরা যদি একসাথে স্বপ্ন দেখতে পারি, তাহলে তা অদম্য হয়ে ওঠে।
সৃষ্টি হোক নতুন সভ্যতা। বর্তমান সভ্যতা আমাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। কেবল পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি একটি আত্ম-বিধ্বংসী সভ্যতায় পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্পদের চরম সঞ্চয়ের দিকে ধাবিত করেছে।
আমাদের তিনটি শূন্য- শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও শূন্য বেকারত্বের বিশ্ব গড়তে হবে- মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য সামাজিক ব্যবসা চালু করার মাধ্যমে মুনাফা বাড়ানোর বদলে শূন্য বেকারত্বের মাধ্যমে আমাদের তরুণরা এখন যেভাবে চাকরি খোঁজে, তার বদলে তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
যথেষ্ট কঠোর প্রয়াস নিলে মানুষের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন আয়োজনের জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।
আপনাদের জন্য ঢাকা কনভারসেশন স্মরণীয় হোক- এই কামনা করছি।
এই কথাগুলো বলে আমি প্রাধিকার বলে বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন উদ্বোধন ঘোষণা করছি।
ধন্যবাদ।