উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে অনলাইন জুয়া। আশঙ্কাজনক হারে আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণরা। শুধু বিদেশ নয়, দেশেও পরিচালিত হচ্ছে বহু জুয়ার সাইট। এক ধরনের কৌতূহল থেকে তরুণ প্রজন্ম আকৃষ্ট হচ্ছে বিভিন্ন জুয়ার সাইটে। পাঁচ-দশ হাজার টাকার বিনিয়োগে শুরু করে লোভে পড়ে এক পর্যায়ে খোয়াচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খেলাসহ নানা ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ জুয়ার বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। ফেসবুক আইডি, পেজ, গ্রুপ, ওয়েবসাইট ও মোবাইলভিত্তিক এনক্রিপ্টেড অ্যাপস দিয়ে চলছে জুয়ার এ সাইটগুলো। জুয়ার এসব সাইটের অধিকাংশ পরিচালনা করা হচ্ছে রাশিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব সাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশের এজেন্টরা।
পুলিশ ও তথ্য প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে অধিকাংশরাই নিঃস্ব হয়ে যায়। তবে এসব সাইট পরিচালনার বিদেশি মূলহোতা ছাড়াও লাভবান হচ্ছে দেশ থেকে যুক্ত থাকা এজেন্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে অনলাইনে জুয়ার টাকা লেনদেন উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এ ধরনের জুয়ার কোনো লেনদেনের নির্দেশনা দেয়া হয়নি। জুয়া কোনোভাবেই ব্যাংকি চ্যানেলের মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে নিশ্চয়ই সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশন নেবে।’
সিআইডি কর্মকর্তাদের দাবি, প্রতিদিন শতাধিক সাইটে বাংলাদেশিরা অনলাইনে জুয়া খেলছে। মূলত প্রযুক্তি আর অর্থ লেনদেনের সহজলভ্যতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিস্তার লাভ করেছে অনলাইন জুয়া। এতে আসক্ত ভুক্তভোগীরা দিন দিন সহিংসপ্রবণ হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, অন্যদিকে দেশের শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক অনলাইন জুয়াড়ি জানান, দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন জুয়ার সাইট ওয়ানএক্সবেট। এছাড়া বেটউইনার, বেট৩৬৫, মেলবেট, প্যারিম্যাচ সাইটও বেশ জনপ্রিয়। এগুলোর বিজ্ঞাপন নিয়মিত দেয়া হয় ফেসবুকে। দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এ সাইটগুলোতে ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলা নিয়ে বাজি ধরা যায়। ক্রিকেটে প্রতি বলে বলে, ম্যাচের প্রথম ওভারের প্রথম বলে, প্রতি ওভারে, প্রতি ম্যাচের প্রথম ছয় ওভার, পরবর্তী ওভারে উইকেট যাবে কি না ও কোন দল জিতবে এমন করে জুয়ার ক্যাটাগরি সাজানো।
এসব সাইটের বেশিরভাগ রাশিয়াকেন্দ্রিক। তবে ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। কিছু দেশি সাইটও রয়েছে।
নিয়মিত অনলাইনে জুয়া খেলতেন হাফিজুল হক (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘ওয়ানএক্সবেটে জুয়া খেলতাম। প্রথমে নগদের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সাইটে খেলা শুরু করি। এক রাতে পাঁচ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা লাভ হয়। পরদিন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় খেলতে গেলে হেরে যাই। পরবর্তী সময়ে দুই লাখের মতো ইনভেস্ট করি। সেখানে খেলতে গিয়েও হেরে যাই।’
বিভিন্ন জুয়ার সাইট এবং অ্যাপ ভিজিট করে দেখা গেছে-ইমেইল, মোবাইল নম্বর ও পাসওয়ার্ড দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। এসব অ্যাকাউন্টে একটি করে ভার্চুয়াল ওয়ালেট যুক্ত থাকে। এতে অবৈধ কারেন্সি অ্যাড করতে বিভিন্ন এজেন্ট দিয়ে এমএফএসের মাধ্যমে টাকা কনভার্ট করা হয়। এই অবৈধ কারেন্সিকে বট ব্যালেন্স বলা হয় যা অনলাইনে জুয়া খেলার জন্য সরাসরি ব্যবহার করা হয়। এসব সাইটে ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন ধরনের গেম খেলার মাধ্যমে জুয়া পরিচালনা করা হয়। এছাড়া দেশ বিদেশের বিভিন্ন ক্রিকেট ম্যাচকে কেন্দ্র করে জমজমাট হয়ে উঠে এসব অনইলান জুয়ার আসর।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, ওয়ানএক্সবেট, মোস্টবেট এর মতো বেশকিছু সাইট নিয়ে তদন্ত চলছে। কিন্তু এ রকম জনপ্রিয় অন্তত ১০০ দেশি-বিদেশি সাইট পুলিশ প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে।
নীরবে কোটি কোটি টাকা পাচার: অনুসন্ধানে জানা যায়, অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে জুয়ার মুদ্রা কেনা হয়। স্থানীয় জুয়া এজেন্ট এমএফএস বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে দেখা করে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এজেন্টরা চক্রের প্রধানের কাছে নগদ টাকা পৌঁছে দেয়। চক্রপ্রধান আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা বাইরের দেশে পাঠায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, পুলিশ তদন্তে দেখা গেছে, প্রত্যেক এমএফএস অ্যাকাউন্টে মাসে ৮৫০ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে। গত বছরে ছয় মাসে অ্যাকাউন্টগুলো ৮১৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। গত বছরের জুনে এ অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়।
পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া অধিকংশ জুয়ার এজেন্টই মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা এলাকার বাসিন্দা। সিআইডি সাইবার পুলিশ সেন্টার ও ডিবি ঢাকায় ৮টি মামলা করেছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় ৬০ জনকে। তাদের অধিকাংশ জামিনে মুক্ত হয়ে ফের অনলাইন জুয়া কার্যক্রমে জড়িত হয়েছে।
পুলিশ বলছে, অন্তত ১০০টি জুয়ার সাইট এখন তাদের নজরদারিতে রয়েছে।
জুয়ার সাইট বন্ধ করেও মিলছে না সমাধান: বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নির্দেশে ২০১৯ সালে বন্ধ করা হয় অনলাইনে জুয়া খেলার ১৭৬টি সাইট। ২০২২ সালে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দেশে অনলাইনে জুয়া খেলার প্রবণতা বাড়ার কথা জানিয়ে তা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
গত বছরের অক্টোবর ১০ তারিখ ৩৩১টি অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা সেল’। সেলটির নিয়মিত নজরদারির অংশ হিসেবে এসব অবৈধ সাইট বন্ধ করা হয়।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সার্চ ইঞ্জিন ‘গুগল’ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনলাইন জুয়া বা বাজি সংক্রান্ত ১৫০টি গুগল অ্যাপস বন্ধের জন্য রিপোর্ট করা হলে এরই মধ্যে গুগল কর্তৃপক্ষ প্লে স্টোর থেকে ১৪টি অ্যাপস বন্ধ করেছে এবং অবশিষ্ট অ্যাপস বন্ধের জন্য যাচাই-বাছাইসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়। একই সঙ্গে ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে জুয়া খেলার ওয়েবসাইট ও গুগল অ্যাপসের প্রচার এবং অনলাইন জুয়া সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ দেয়ায় এ ধরনের ২৭টি ফেসবুক লিংক, ৬৯টি ইউটিউব লিংক বন্ধের জন্য রিপোর্ট করা হয়। এর মধ্যে ১৭টি ফেসবুক লিংক ও ১৭টি ইউটিউব লিংক বন্ধ করা হয়েছে।
অনলাইন জুয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অথবা অন্য কোনো অনলাইন বা ইলেকট্রনিক বা ডিজিটাল মাধ্যমে খেলাধুলা বা এুসংক্রান্ত অন্য কোনো বিষয়ে বাজি ধরা হয়। বাজির লেনদেনের জন্য জুয়াড়িরা ক্যাশবিহীন ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি) বা মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, পেপাল ইত্যাদি) বা বিটকয়েনসহ অন্য যেকোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি ব্যবহার করতে পছন্দ করেন।
কারণ, এতে সহজে ধরা পড়ার ভয় নেই। জুয়ায় সহজে টাকা আয় করা যায় প্রাথমিকভাবে। এটিও জুয়ার প্রতি মানুষকে আকর্ষিত করার ফাঁদ। কয়েকবার স্বল্প পরিমাণে টাকা পেয়ে যারা জুয়া খেলেন, তারা লোভে পড়ে যান। কম পরিশ্রমে বেশি লাভের জন্য এরপর জুয়াড়িরা বেশি টাকা দেন জুয়ায়। যখন দেয়া মূল টাকা ফেরত আসে না, তখন পরেরবার নিশ্চয়ই ফেরত পাব, এই আশায় আবার টাকা খরচ করেন তারা। পরবর্তী সময়ে সেই টাকাও না পেলে দিশাহারা হয়ে ওই টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো উপায় না পেয়ে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বারবার টাকা দিতে থাকেন জুয়ায়।
দ্রুত জামিনের ফলে আবার সক্রিয় হয় অভিযুক্তরা: দেশে সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী লোকের ছত্রচ্ছায়ায় বিভিন্ন ক্লাবে আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ ক্যাসিনো গড়ে উঠেছিল। পুরোপুরি অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ক্যাসিনোগুলো ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করে। এরপরই মূলত ধীরে ধীরে অনলাইনে বিস্তার হতে শুরু করে জুয়ার সাইটগুলো। যা ২০২০ সালে বেশকিছু অভিযানে গ্রেপ্তারের পর স্পষ্ট হয়। তবে ওই সময় থেকেই ধারাবাহিকভাবে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্ত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের পর খুব দ্রুতই তারা জামিনে বেরিয়ে পরে। এরপর তারা আবার গড়ে তুলে জুয়ার সাইট।
সাইবার নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরিফ মাঈনুদ্দীন বলছেন, বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯০ শতাংশের মোবাইল ফোনে এমন (জুয়ার) অ্যাপস পাওয়া যাচ্ছে। বিট কয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সির এ খেলায় দুই ধাপে টাকাগুলো দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। শুরুর দিকে কিছু লাভ দেখিয়ে পরে মোটা অংকের টাকা নিয়ে প্রতারকরা সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে বলেও জানান তিনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেয়া তথ্যে মাঝে মাঝে এসব সাইট বন্ধের উদ্যোগ নেয় বিটিআরসি। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাতেও খুব একটা লাভ হয় না।
যা বলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী: র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক ও মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে ততোধিক চক্র বিভিন্ন সিক্রেট গ্রুপে জুয়ায় আসক্তদের যুক্ত করে। তাছাড়া জুয়া পরিচালনাকারীরা বেকার যুবকদের অল্প সময়ে টাকা কামানোর লোভ দেখিয়ে তাদের সর্বস্ব লুটে নেয়। অবৈধভাবে ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে বিদেশে অর্থপাচারও করে জুয়া পরিচালনাকারীরা। বিশেষ করে আইপিএল, বিপিএল ও বিশ্বকাপের সময় এসব লেনদেন বেড়ে যায়। বেশিরভাগ জুয়া হয় ক্রিকেট ও ফুটবল নিয়ে। মানি লন্ডারিং নিয়ে সিআইডি কাজ করলেও অনলাইন জুয়াড়ি চক্রের বিরুদ্ধে র্যাবও মনিটরিং ও অভিযান পরিচালনা করে থাকে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ বলেন, ‘অনলাইন জুয়ার বিস্তৃতি অনেক বেড়েছে। আমরা মনিটর করছি। যে সব ক্ষেত্রে সুযোগ আছে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে মামলাগুলো করা হয় পুলিশ বাদী হয়ে। এক্ষেত্রে অপরাধীদের খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। তাই বিটিআরসিকে সব জানানো হচ্ছে, যাতে তারা সাইটগুলো বন্ধ করে দেয়।’