ঈদে সিরাজগঞ্জের তাঁতীরা শাড়ি-লুঙ্গী তৈরিতে কর্মব্যস্ত থাকলেও পাইকারি হাটগুলোতেও আশানুরূপ ব্যবসায়ীদের সোরগোল নেই। গত ঈদে প্রায় চার সহস্রাধিক কোটি টাকার ব্যবসা হলেও এবার তা ৩৫শ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। কাঁচামালের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি আনুপাতিক হারে থ্রি-পিসের ব্যবহারসহ নানা কারণে শাড়ি-লুঙ্গীর আশাতীত লাভ হচ্ছে না তাঁতীদের। তবে গত কয়েক বছরের ন্যায় দুই ঈদের পরিবর্তে এপার-ওপার দুই বাংলায় দুর্গাপূজায় এখন এ অঞ্চলের শাড়ির প্রধান বাজার। তাই চাহিদার সে বাজার ধরতে বিজ্ঞ তাঁতীরা এখন থেকেই বাহারী সুতি শাড়ি তৈরির পরামর্শ দিয়েছে ছোট-বড় সকল তাঁতীকে। যমুনার পুর্বপাড় টাঙ্গাইল ও পশ্চিম পাড়ের সিরাজগঞ্জ হচ্ছে পৃথিবীর অনন্য সুতি শাড়ি তৈরির জেলা। এদিক থেকে আবার অনেকটা এগিয়ে থাকায় সরকারিভাবে সিরাজগঞ্জ জেলার ব্র্যান্ডিং নাম ‘তাঁত কুঞ্জ’। জেলার শাহজাদপুর, বেলকুচি, এনায়েতপুর, সদর, উল্লাপাড়ায় উপজেলার ৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকায় এই তাঁত শিল্পের অবস্থান। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, বর্তমানে প্রায় ৪৬ হাজার ৪০৩টি তাঁতী পরিবার অন্তত ২০ হাজার তাঁত কারখানায় প্রায় চার লাখ পাঁচ হাজার ৬৭৯টি হস্তচালিত ও ইঞ্জিন চালিত তাঁত পরিচালনা করছে। এতে শাড়ি-লুঙ্গী, ধুতি, গামছা, থ্রি-পিস উৎপাদন, বিক্রিসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২০ লাখ আট হাজার ১৫৬ জন জড়িত রয়েছে। কোনো পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই তৃনমূল উদ্যোগে বিশ্বে এমন শিল্প সমৃদ্ধ অঞ্চল অনেকটাই বিরল। বর্তমানে এ শিল্পের পণ্য দুই ঈদ, পূজা, বাংলা নববর্ষসহ মানুষের সারা বছরের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে রোজার ঈদকে প্রাধান্য রেখে দীর্ঘ দিন ধরে পরিচালিত এ ব্যবসার প্রসারে দিন ও রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জের প্রায় আট লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারীরা। ঈদের দেড় মাস আগে থেকে তাদের এ মহা প্রস্তুতি চলছে। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, উল্লাপাড়া ও সদর উপজেলার তাঁত কারখানায় মাকুরের খটখট শব্দে মুখরিত। চাহিদার বিপরীতে দিন-রাত পরিশ্রমে তৈরি হচ্ছে বাহারী নকশার সুতি, সিল্ক, রেশমী, জামদানী শাড়ি ও নানান ধরনের লুঙ্গী। তবে শাড়ি-লুঙ্গীর শাহজাদপুর, সোহাগপুর, এনায়েতপুর কাপড়ের হাটগুলোতে নেই তেমন চাঙ্গাভাব। রং, সুতাসহ অন্যান্য কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখনো ভাবাচ্ছে তাদের। এ ব্যাপারে এনায়েতপুর থানার খুকনী গ্রামের ফিরোজ ইউভিংয়ের স্বত্বাধিকারী হাজী অনিক হাসান ফিরোজ, মিটন কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী মাঈদুল ইসলাম মিন্টু জানান, ঈদ উপলক্ষে আমাদের কারখানাগুলোতে এক থেকে তিন হাজার টাকা দামে বাহারী নকশার শাড়ি তৈরি হচ্ছে। অন্যান্য বছর পাইকারী হাটে তেমন নিয়ে যেতে হয়নি। সারা দেশের ব্যাপারীরা বাড়িতে এসেই কিনতো বেশ ভালো দাম দিয়ে। তবে এবার অতোটা বাজার ভালো যাচ্ছে না। হাটে-বাড়িতে বিক্রি হচ্ছে শাড়ি লুঙ্গী ঠিকই তবে লাভের হার কম। তাছাড়া উৎপাদনের কাঁচামাল রং, সুতাসহ অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েই চলছে। সব মিলিয়ে এবার কাঙ্খিত বাজার পাচ্ছি না আমরা। গোপালপুর গ্রামের তাঁত শ্রমিক সোলায়মান হোসেন, শিবপুরের শুকুর আলী, গোপিনাথপুরের নুরু মিয়া বলেন, শুধু মহাজনের কাপড় বেশি উৎপাদনকেই প্রাধান্য দিচ্ছে না তারা। অতিরিক্ত পরিশ্রমে বাড়তি আয়ে মিটবে পরিজন নিয়ে ঈদ উৎসবের আনন্দ। তারা বলেন, ঈদ মৌসুমের আগে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করতাম। এখন সেখানে সাহারি খেয়ে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করছি। কারণ যত কাজ করবো তত পারিশ্রমিক পাবো। উপার্জিত এ অর্থ দিয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদ আনন্দ করবো, পোশাক কিনবো। শাড়ি-লুঙ্গী কিনতে আসা নরসিংদী জেলার বাবুর হাটের ব্যাপারী অজয় দেবনাথ ও হবিগঞ্জ শহরের ব্যবসায়ী জহরলাল সরকার জানান, আমাদের দেশীয় তাঁতে তৈরি শাড়ির ব্যবহার আগের চেয়ে কমেছে। অনেকেই এখন থ্রি-পিসের প্রতি ঝুঁকেছে। তাই গতবার যেখানে আমরা তিন হাজার পিস শাড়ি কিনেছি। এবার তা নামিয়ে ৪শতে এনেছি। এ অবস্থায় বিদেশি জরজের্ট, পলেস্টার থ্রি-পিসের পরিবর্তে দেশীয় তাঁতের স্বাস্থ্যসম্মত শতভাগ সুতি কাপড়ের দিকে সবার নজরে থাকা দরকার। অপরদিকে ব্যবসায় কিছুটা মন্দাভাব থাকলেও চলতি মৌসুমে বেশ কেনা-বেঁচা হচ্ছে উৎপাদিত তাঁত পণ্যের। তবে এখন এর প্রধান বাজার সৃষ্টি হয়েছে পূজার। শুল্কমুক্ত কোঠায় বাংলার তাঁত পণ্য ১৩ বছর ধরে ভারতের বাজারে যাচ্ছে এবং সেখানকার মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে বাংলার সুতি শাড়ি। এ কারনে বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার শুধু সুতি শাড়ি রপ্তানি হচ্ছে। আর সেখানে বড় বাজার মূলত দুর্গাপূজা উৎসবকে কেন্দ্র করে। এছাড়া আমাদের দেশেও পূজায়ও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে সিরাজগঞ্জের তাঁতের শাড়ির। ভারতের কলকাতাসহ অন্যান্য প্রদেশে বাংলার সুতি শাড়ীর অন্যতম বিক্রেতা লাভলু-বাবলু কম্পোজিট টেক্সস্টাইল ও টাঙ্গাইল তাঁত বাজারের চেয়ারম্যান আফজাল হোসেন লাভলু ও এমডি তফাজ্জল হোসেন বাবলু জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের তাঁতীদের প্রধান বাজার আর ঈদে নেই। এখন দুর্গাপূজা হচ্ছে অন্যতম বাজার। এপাড়-ওপাড় দুই বাংলাতেই সুতি শাড়ীর থাকে ব্যাপক চাহিদা। বর্তমানে ঈদেও বেশ বিক্রি হচ্ছে। তবে অনেকটা অকেশনের মত। তাই তাদের পরমর্শ সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের তাঁতী ভাইদের বলবো, অনন্য নকশার বাহারী সুতি শাড়ি তৈরি করুন। ঈদের পর তা ব্যাপারীদের দিয়ে সাড়তে পারবেন না। মুনাফাও হবে বেশ। তারা জানান, দেশীয় পোশাকের প্রতি দরদ না থাকলে আমাদের তাঁত পণ্যের প্রসার হবে না। তাই থ্রি-পিসের পাশাপাশি শাড়িকে সবার প্রাধান্য দিতে হবে।
তাঁতীদের জন্য সরকারি পৃষ্টপোষকতা চেয়ে বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম পাওয়ারলুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিরাজগঞ্জ জেলা কমিটির সভাপতি হাজী বদিউজ্জামান বদি জানান, এবার কিছুটা বাজার চাঙ্গা না থাকলেও ঈদ উপলক্ষে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হবে। তবে আশাতীত মুনাফা হবেনা। কারন, আমাদের উৎপাদিত পন্যের সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও নতুন বাজার সেভাবে সৃষ্টি হচ্ছে না। তাই বাজার সৃষ্টির দিকে সরকারের নজর দিতে হবে। পাশাপাশি পণ্য তৈরির কাঁচামালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতেও নজরদারী করতে হবে। তবেই আরো সমৃদ্ধ হবে বাংলার তাঁত শিল্প।