জমানো টাকা শেষ, এখন ঋণ করেই চলছি। সহকর্মীর কাছ থেকে ধার করে ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। নিজের উপার্জিত অর্থে ডিম আর পাঙ্গাসও কিনতে পারি না। অভাবের কথা কাউকে বলতে আর ভালো লাগে না। জানি না সামনের দিন কীভাবে কাটবে— বলতেই মুখটা মলিন হয়ে গেল রাকিব মিয়ার। বেসরকারি এই চাকরিজীবী থাকেন রাজধানীর মেরাদিয়ায়। সম্প্রতি তার সঙ্গে কথা হয়। জানান আর্থিক সংকটে দিনাতিপাতের কথা।
রাকিব মিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় সামনে এলেন বনশ্রীর বাসিন্দা মঈনুল ইসলাম। পেশায় ব্যাংকার। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে কথা বলতে এসেছেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেন, সংসারে দুই মেয়ে এক ছেলে। তারা স্কুলে পড়ে। দুই বছরে সবকিছুর মূল্য বেড়েছে। এখন তো নাগালের বাইরে। বাচ্চাদের খাবারের তালিকায় ভালো কিছু রাখতে পারছি না। পাঙ্গাস আর ডিম কেনার সামর্থ্যও যেন হারিয়ে ফেলছি।
অনেকেই বলছেন, দেশে নানামুখী সংকট বাড়ছে। মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় দ্বিগুণ হচ্ছে। করোনা মহামারিতে অনেকেই চাকরি হরিয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন করে চাকরি পাননি। সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন অনেকে। এরপর দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সব মিলে চরম দুর্দশায় পড়তে হয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের।
তারা আরও জানা, গরিবদের খাবারে আমিষের যোগান কমেছে। ডিম-পাঙ্গাসের ওপর ভরসা বহু পরিবারের। তবে সেই পথও এখন ক্ষীণ, কারণ নতুন করে দাম বাড়ছে ডিমেরও। একহালি ডিম কিনতে লাগছে ৫০ টাকা। মধ্যবিত্তদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য উল্লেখযোগ্য ছিল তারাও এখন পথে বসার দ্বারপ্রান্তে।
বাজারে মাছের মধ্যে সবচেয়ে দামে কম ছিল পাঙ্গাস মাছ। যা এখন কিনতে গুনতে হয় ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। এছাড়াও বেড়েছে সব মাছের দাম। প্রতি কেজি কাতলা মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়, তেলাপিয়া ২২০ টাকায়, পাবদা ৪৫০ টাকা, মলা ৩৬০ টাকা, শোল ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা, শিং মাছ ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা, কৈ ২৬০ টাকা, বোয়াল ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা, টেংরা (ছোট) ৫০০ আর বড় ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা, রুই ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা, চিংড়ি ৬০০ এবং গলদা চিংড়ি ৭০০ টাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে।
অন্যদিকে বাজারে প্রতি পিস ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, একইভাবে বাঁধাকপিও প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়, ব্রুকলি প্রতি পিস ৫০ টাকা, বেগুন প্রতি কেজি ৬০ টাকা, টমেটো প্রতি কেজি ৫০ টাকা, গাঁজর প্রতি কেজি ৪০ টাকা, সিম প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, ঝিঙা প্রতি কেজি ৬০ টাকা, মুলা প্রতি কেজি ৩০ টাকা, শালগম প্রতি কেজি ৩০, খিরা প্রতি কেজি ৩০ টাকা, ফুলকা প্রতি আটি ১৫-২০ টাকা, শসা প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। পটল প্রতি কেজি ১২০ টাকা, নতুন আলু প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, লাউ প্রতি পিস ৬০ থেকে ৭০ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা এবং মিষ্টি কুমড়া প্রতি কেজি ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জানিয়েছে, চাল, সবজি, বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ ও গ্যাসসহ প্রায় সমস্ত ভোগ্যপণ্য ও সেবার দাম বাড়ায় এক বছরের ব্যবধানে সার্বিকভাবে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১১ শতাংশ।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপভিত্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিগত ছয় মাসে তাদের ওপর বড় আঘাত কী। জবাবে ৮৮ শতাংশ মানুষ খাদ্যের চওড়া দামকে বড় আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আরও তিনটি বিষয় বড় আঘাত হিসেবে উঠে এসেছে রোগ ও চিকিৎসা ব্যয়, তেলের দাম ও পরিবহন ব্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এছাড়া খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ বলে জানানো হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, আট ধরনের প্রাণিজ আমিষে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান আছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে— মাছ, মাংস, সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদানসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবার। বাকিরা পারছে না। সাধারণভাবে শিশু, গর্ভবতী মা ও অপুষ্টিতে ভোগা নারীদের এ ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। এই খাবারগুলো তাদের নিয়মিত না পাওয়া আশঙ্কাজনক।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, দেশের নিম্ন আয়ের মানুষের উপার্জনের ৭০ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্য কিনতে। অনেক সময় খাবার কম কিনে অন্যান্য ব্যয় মেটাতে হয় তাদের। ফলে সেসব পরিবারের সদস্যদের ভুগতে হয় অপুষ্টিতে।