চলনবিল নাম শুনলেই গা ছমছম করে। থইথই জলে উথালপাথাল ঢেউয়ের কথা ভেবে। তবে চলনের এ রূপ বর্ষার। ষড়ঋতুর এই দেশে প্রতি ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নেয় চলনবিল। বর্তমানে এ বিলে প্রাকৃতিক জলাশয়ে জন্ম নেওয়া শামুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন নিম্ন আয়ের হাজারও মানুষ। বিলাঞ্চলে তেমন কাজ না থাকায় কর্মহীন এসব মানুষ এ উপায়ে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। জানা যায়, চলনবিলের ১৬টি নদী, ৩৯টি বিল ও ২২টি খাড়িসহ বিভিন্ন জলাভূমি থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০০ মেট্রিক টন শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করা হয়। এসব জলাভূমি থেকে একজন নিম্ন আয়ের নারী, পুরুষ ও শিশুরা গড়ে প্রতিদিন দুই বস্তা শামুক কুড়ায়। যা বেচাকেনার জন্য পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাংগুরা, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, তাড়াশ ও নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলায় ৫০টিরও বেশি আড়ৎ গড়ে উঠেছে। শামুক সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে আড়তদাররা প্রতি বস্তা ৪০০-৫০০ টাকা দরে কিনে নেন। এসব শামুক কিনে ট্রাকে রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, বগুড়া, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণাঞ্চলের মাছের ঘেরের মালিকদের কাছে প্রতি বস্তা ৭০০-৮০০ টাকা দরে বিক্রি করেন। সারাদিনের কুড়ানো শামুক বিকেলে বিভিন্ন স্থানে জড়ো করেন। এরপর ব্যবসায়ীর (ক্রেতা) কাছে বিক্রি করেন। প্রতি বস্তা শামুক বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চালান। শামুক সংগ্রহের কাজ চলে বছরের আষাঢ়-কার্তিক মাস পর্যন্ত। শামুক সংগ্রহকারী অনেকেই জানান, এ বছর জলাশয়গুলোতে নামলে শরীর চুলকাচ্ছে। তারপরও জীবিকার প্রয়োজনে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন এ কাজ করতে। তাড়াশ উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের মাকড়শোন এলাকায় গড়ে ওঠা শামুকের ভাসমান হাটে দেখা যায়, প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত অন্য হাটের মতোই পাইকারি দরে শামুক বেচাকেনা হচ্ছে। রাস্তার পাশে রাখা হয়েছে নৌকা আর সেখানে শতাধিক বস্তা শামুক। ফড়িয়া ও সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে বস্তা হিসেবে শামুক কিনে নিচ্ছেন আড়তদাররা। এসব আড়তদারের কাছে শামুক বিক্রি করতে আসা উপজেলার সগুনা গ্রামের সজিব হোসেন বলেন, ‘এলাকার দরিদ্র ছেলেমেয়েরা শামুক-ঝিনুক স্ংগ্রহ করে। তাদের কাছ থেকে কিনে এনে আমরা এখানে বিক্রি করি।’ কথা হয় তাড়াশ উপজেলার কুন্দইল গ্রামের আজিজুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আগে চলনবিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এতেই জীবিকা নির্বাহ করা যেত। কিন্তু বর্তমানে বিলে পর্যাপ্ত মাছ না থাকায় সংসার চলে না। তাই বাধ্য হয়ে শামুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। প্রতিদিন গড়ে ২ বস্তা শামুক সংগ্রহ করতে পারি। এতে যা আয় হয়, তাই দিয়ে সংসার চালাই।’ একই উপজেলার মাকশোন গ্রামের গোলাম সেখ বলেন, ‘পাঁচ থেকে ছয়জনের একটি দল নৌকা ও জাল নিয়ে চলনবিলের বিভিন্ন খালে যাই। সারারাত জাল ফেলে শামুক সংগ্রহ করি। এরপর সকালে শামুক থেকে অন্য ময়লা ফেলে ৩০-৪০টি বস্তায় ভরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করি। এতে প্রতিদিন ৪ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকা আয় হয়।’ শামুক কিনতে আসা পাইকার রবিউল হোসেন বলেন, ‘হাঁস খামারিদের কাছে শামুকের ব্যাপক চাহিদা আছে। এ কারণে জেলেদের কাছ থেকে শামুক কিনে দেশের বিভিন্ন জেলার হাঁস খামারিদের কাছে বিক্রি করি। অপরদিকে ঘের মালিকরা শামুক-ঝিনুকের মাংস বের করে নেওয়ার পর খোলস বিক্রি করে দেয়। পোলট্রি ও ফিশমিল্ক তৈরিকারকরা এই খোলস কিনে নেন। শামুক-ঝিনুকের খোলস রোদে শুকিয়ে মেশিন দিয়ে গুঁড়া করা হয়। পরে নেটিং মেশিনে দিলে দু’ধরনের প্রক্রিয়াজাত দ্রব্য পাওয়া যায়। এর একটি পাউডার, অপরটি দানা পাউডার। ফিশমিল্ক তৈরিতে পাউডার এবং মুরগির খাবার তৈরিতে দানা পাউডার ব্যবহার করা হয়। উৎপাদিত দানা পাউডার প্যাকেটজাত করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়।’ এদিকে নির্বিচারে শামুক নিধনের ফলে মাটির উর্বতা ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি করছেন তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মর্জিনা ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চলনবিল অঞ্চলে যেসব শামুক ধরা হয়, তা মূলত অ্যাপেল স্নেইল (আপেল শামুক) গোত্রের। এই শামুক ধরে নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মাছের ঘেরের যে চিংড়িকে খাওয়ানো হচ্ছে; সেগুলো আমাদের দেশের মানুষ পাচ্ছে না। অথচ প্রতিদিন চলনবিল থেকে প্রায় ২০০ টন শামুক ধরা হচ্ছে।’ তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শামুক প্রাকৃতিক সম্পদ। আমার জানা মতে, এ অঞ্চল থেকে নিয়ে যাওয়া শামুকের ভেতরের অংশ মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। খোলস ব্যবহার হয় চুন ও সার তৈরিতে। তবে নির্বিচারে শামুক নিধন এ অঞ্চলের জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি ও খাদ্যশৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর। এটি নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’ তবে শামুকের অনেক পুষ্টিগুণ আছে। মাছের এবং হাঁসের খাদ্য হিসেবে শামুক ব্যবহৃত হয়। তাই চলনবিলে শামুক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রকল্প গ্রহণ করার পরিকল্পনা আছে বলে জানান উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশগুল আজাদ।