তিন মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে সাজানো সংসার ছিলো নৌকার মাঝি মো. ওক চাঁন শেখের (৫০)। বন্যায় যমুনা নদীর ভাঙনের কারণে তার সেই গোছানো সংসার এখন তছনছ। চোখের সামনে নদী গ্রাস করেছে তার মাথাগোঁজার ঠাঁই। ঘর হারিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঠাঁই হয়েছে পরিবারটির। এভাবেই নদী ভাঙনে দিনের পর দিন পাল্টে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জের চার উপজেলার মানচিত্র। স্থানীয়রা জানান, চলতি বছরের জুলাই মাসে সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলে দেখা দেয় যমুনা নদীতে ভাঙন। সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের সয়াশিখা, বর্ণি, কৈগাড়ী দোরতা, কাজিপুরের খাসরাজবাড়ি ইউনিয়নের সানবান্ধা ঘাট থেকে বিশুরি গাছা ঘাট ও শাহজাদপুরের জালালপুর ইউনিয়নের পাঁচিল, হাট পাঁচিল, জালালপুর ও সৈয়দপুর ও চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চরসলিমাবাদ দক্ষিণ পাড়ায় যমুনা নদীতে তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড জিওব্যাগ ফেললেও বর্ষা মৌসুমে সেটা কোনো কাজেই আসেনি। যমুনার ভাঙনে জেলার চারটি উপজেলায় আট শতাধিক বসতবাড়ি ও প্রচুর পরিমাণে ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। এর মধ্যে দুই তলা একটি বিল্ডিং, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা এবং ৭০ বছরের পুরাতন কবরস্থানও রয়েছে। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ইউনিয়নের কৈগাড়ী দোরতা গ্রামের ওক চাঁন বলেন, ‘আমার ৮ শতক জায়গার ওপরে দুইটি ঘর ও একটি গরুর গোয়াল ছিল। নদীদে সব বিলীন হয়েছে। আমার প্রায় ২ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে। এই বয়সে ক্ষতি কীভাবে পূরণ করবো আল্লাহ ভালো জানেন। বর্তমানে পরিবার নিয়ে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে আছি।’ কাওয়াকোল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান (জিয়া মুন্সি) বলেন, ‘নদীভাঙনে জেলার মানচিত্র থেকে মুছে যেতে চলেছে এই ইউনিয়ন। ভাঙন রোধে পাউবো কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। কাওয়াকোলা ইউনিয়নের হাট বয়ড়া, দৌগাছী, বড় কয়রা, ছোট কয়রা, কৈগাড়ী দড়তা, চন্ডল বয়ড়া ও বেড়াবাড়ি গ্রামে নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। এরই মধ্যে অনেক গ্রাম নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৩ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীতে চলে গেছে। ভাঙনের কারণে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক নিলামে বিক্রি করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে হাটবয়ড়া, দোগাছি, বড়কয়ড়া, ছোটকয়ড়া, চন্ডাল বয়ড়া, বেড়াবাড়ি, কৈগাড়ি, দোরতা ও বর্ণি গ্রামের আরো পাঁচ শতাধিক বাড়ি, চার কিলোমিটার পাকা রাস্তা, কয়েকশ একর ফসলি জমি, মুজিব কিল্লা, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর অধীন ১২৬টি ব্যারাক, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, ছয়টি সরকারি প্রাইমারি স্কুল এবং একটি বিদ্যালয় ভবন।’ শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাঁট পাচিল গ্রামে নিজের দোতলা বিল্ডিং চোখের সামনে নদীতে বিলীন হতে দেখেছেন কোবাদ মাস্টার। তিনি বলেন, ‘নদীতে পানি বৃদ্ধি ও কমার সময় তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। আমার একটি দোতলা বাড়ি এবং পাশেই বিশাল গরুর খামার নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙন কবলিত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করেছেন ইউএনও। আমাদের এলাকাবাসী কোনো ত্রাণ চায় না, এক বান্ডিল টিনও চায় না। তারা চায় দ্রুত নদী ভাঙনরোধে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’ কৈজুড়ী ইউনিয়নের পাচিল এলাকার মাসুদ রানা বলেন, ‘অনেক কষ্ট লাগে। নানা বাড়ির গ্রামটা চোখের সামনে শেষ হয়ে গেলো। এই হাটপাঁচিল গ্রামে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এই গ্রামে আমার অনেক স্মৃতি আছে। আজ যমুনা নদীতে সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড় নয়, বুকের এক একটা করে পাঁজর ভাঙছে। ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে নদীপাড়ের মানুষ।’ এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন খোকন বলেন, ‘এবারের বন্যায় হাঁট পাচিলে তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে।