টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে আওয়ামী লীগ-বিএনপির একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী আগাম গণসংযোগ করছেন। সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের জন্যই গলার কাঁটা হিসেবে দেখছেন নির্বাচনবোদ্ধারা। আসনটি বরাবরই ভিআইপি আসন হিসেবে চিহ্নিত। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজ প্রয়াত। মুক্তিযুদ্ধে টাঙ্গাইলের সংগঠক, সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী রাজনীতির মাঠ থেকে ছিটকে পড়েছেন। তারা ছিলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। লতিফ সিদ্দিকী হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্যের কারণে মন্ত্রিত্ব হারান। দল থেকে বহিষ্কৃত হন এবং সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। দলীয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও লতিফ সিদ্দিকী মনে করেন, তিনি সাচ্চা আওয়ামী লীগার। আওয়ামী লীগ থেকে কেউ তাকে সরাতে পারবে না। তিনি এখনো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থাশীল। নির্বাচনে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, এমন আভাস দিয়েছেন তার কাছের লোকজন। কোনো কারণে নির্বাচনে অংশ না নিলে তার সহধর্মিণী সাবেক এমপি বেগম লায়লা সিদ্দিকী নির্বাচন করবেন, এমন আলোচনা স্থানীয় পর্যায়ে চাউর হয়েছে। সংসদ থেকে পদত্যাগের পর লতিফ সিদ্দিকী নিয়মিত সস্ত্রীক এলাকায় যাতায়াত করছেন। সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের মেয়ে ব্যারিস্টার সরোয়াত সিরাজ শুক্লা (শুক্লা সিরাজ) প্রয়াত বাবার অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। ঢাকার গুলশান সোসাইটির সাবেক সেক্রেটারি শুক্লা এবারের নির্বাচনে অংশ নেবেন, এমনটিই মনে করছেন তার কাছের লোকজন। স্থানীয় রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করছেন, এ আসনটি মহাজোটকে আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিতে পারে। মহাজোটের অন্যতম শরিক দল জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য (এরশাদ) প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী মনোনয়ন পেতে পারেন। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও মনোনয়ন দাবি করে আসছে। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের স্থানীয় সভা-সমাবেশে সা’দত কলেজের সাবেক ভিপি শামীম আল মনসুর আজাদ সিদ্দিকী কৌশলে তার প্রার্থিতার ব্যাপারটি জানান দিচ্ছেন। ২০০৮ সালে শাজাহান সিরাজ জেল-হাজতে থাকায় তখন এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য শিল্পপতি লুৎফর রহমান মতিন। তিনি আওয়ামী লীগের আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর কাছে পরাজিত হন। এখানে শাসক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অন্তর্কলহ সীমাহীন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো দৃঢ় সাংগঠনিক দক্ষতায় নিয়ন্ত্রণ করতেন লতিফ সিদ্দিকী। তার অনুপস্থিতিতে দলের সর্বেসর্বা এখন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোজহারুল ইসলাম তালুকদার। লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগের পর উপনির্বাচনে এমপি হন মোহাম্মদ হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারী। একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে মোহাম্মদ হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারী নির্বাচিত হন। তার সঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদারের সুসম্পর্ক থাকলেও ভেতরে ভেতরে দূরত্ব যোজন যোজন। উভয়ের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক সাপে-নেউলে। কেউ কাউকে সহ্য করেন না। মোজহারুল ইসলাম তালুকদারের অভিযোগ, এমপি সোহেল হাজারী বিএনপি-জামায়াতের লোকজন সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করেন, আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের কোনো গুরুত্ব দেন না। এমপি সোহেল হাজারীর বক্তব্য হচ্ছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাকে দলীয় কাজে খুব কমই ডাকেন, যথাযথ মূল্যায়নও করেন না। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তিনি নিজে গিয়েই উপস্থিত হন। সোহেল হাজারীই দলীয় মনোনয়ন পাবেন, এমন বিশ্বাস তার কর্মী-সমর্থকদের। তবে এক আওয়ামী লীগ নেতা তার শিক্ষা সনদ জালিয়াতির অভিযোগ এনে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের এবং উচ্চ আদালত কর্তৃক কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার বিষয়টি স্থানীয় রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সোহেল হাজারী মনে করেন, বিষয়টি আদালতের। তিনি আদালতেই জবাব দেবেন। তিনি এমপি নির্বাচিত হয়ে কালিহাতী উপজেলা সদর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। স্বাধীনতার পর তিনিই সবচেয়ে বেশি কালিহাতীর উন্নয়ন করেছেন বলে দাবি করেন। দল তার কাজের মূল্যায়ন করবে বলে সোহেল হাজারীর বিশ্বাস। হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারী এমপি বলেন, ‘বিগত এমপিদের সময়ে যে পরিমাণে উন্নয়ন হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। আমার সময়ে যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে, তা অন্য এমপিরা মন্ত্রী হয়েও করতে পারেননি। দল আমাকে মনোনয়ন দেবে, এতে আমি শতভাগ আশাবাদী।’ দলীয় মনোনয়ন পেতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠাণ্ডু দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ‘যাকে নৌকা দেওয়া হবে, তার পক্ষেই আছি। অন্য কাউকে দিলে তাকেই সমর্থন করব। নৌকা প্রতীকের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’ সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি মনোনয়ন চাইব। যদি শেখ হাসিনা মনে করেন আমাকে প্রয়োজন, তাহলে দেবেন। না দিলেও আমি কালিহাতীর মানুষের কথা চিন্তা করে নির্বাচনের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’ লায়লা সিদ্দিকী খবরের কাগজকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার প্রতি আমার আস্থা আছে যে লতিফ সিদ্দিকী মনোনয়ন পাবেন। যদি না পান, সে ক্ষেত্রে আমি দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। আমি ১৯৮৬ সালে এই আসনের এমপি ছিলাম।’ এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবু নাসের আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির অন্তর্কলহও চরমে। স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক প্রয়াত শাজাহান সিরাজের অনুসারীরা কার্যত তার কন্যা শুক্লা সিরাজের পক্ষে কাজ করছেন। বিএনপি নেতা লুৎফর রহমান মতিন ও বেনজীর আহমেদ টিটোরও রয়েছে নিজ নিজ গ্রুপ। ২০০৮ সালে বিএনপি থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শিল্পপতি লুৎফর রহমান মতিন পরাজিত হলেও ভোট পেয়েছিলেন ৮৬ হাজার ৯১২টি। কিন্তু নির্বাচনের পরই তিনি দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। সরকারবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে দলীয় নেতা-কর্মীরা তাকে পাশে পাননি। এর ফলে আন্দোলন-সংগ্রামে মামলা-হামলার শিকার হওয়া নেতা-কর্মীরা এলেঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. শাফী খানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। জেলা বিএনপি নেতা মো. শাফী খান তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের প্রিয়পাত্র। কালিহাতী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি শিল্পপতি লুৎফর রহমান মতিনের সঙ্গে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক সাবেক মন্ত্রী শাজাহান সিরাজের সহধর্মিণী বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য বেগম রাবেয়া সিরাজের দ্বন্দ্ব রয়েছে। রাবেয়া সিরাজের মেয়ে শুক্লা সিরাজ দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন। উপজেলা বিএনপির একটি অংশ মনে করে, শিল্পপতি লুৎফর রহমান মতিন ব্যবসায়ী হলেও কালিহাতী বিএনপির রাজনীতিতে তার প্রয়োজন রয়েছে। কোন্দলের মধ্যে দলের হাল ধরেন সাবেক ছাত্রদল নেতা বেনজীর আহমেদ টিটো। তিনি এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ)। টিটো একজন শক্তিশালী মনোনয়নপ্রত্যাশী। মালয়েশিয়া বিএনপির সভাপতি প্রকৌশলী বাদলুর রহমান খান বাদল ও কালিহাতী উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শুকুর মামুদ দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। বাদলুর রহমান খান বাদল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ব্যবসায়ী পার্টনার। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক (ঢাকা বিভাগ) বেনজীর আহমেদ টিটো বলেন, ‘দল নির্বাচনে গেলে আমি মনোনয়ন পাব।’ জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী বলেন, ‘মহাজোটে কথা হয়েছে আমাকে এই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হবে।’ এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আবু নাছের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমাকে মূল্যায়ন করবে বলে বিশ্বাস করি। সব সময় দলের সিদ্ধান্ত মেনে নেব।’