সীমান্তবর্তী সমতল থেকে কিছুটা উঁচু বরেন্দ্র ভূমি হিসাবে পরিচিত উপজেলা সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর নিয়ে সংসদীয় আসন ৪৬ কথা নওগাঁ-১। সুস্বাদু আমের ভাল ফলন ও দাম পাওয়ায় এখানকার মানুষের জীবন ধারায় গত এক দশক ধরে এসেছে পরিবর্তর। ভোট যুদ্ধে এই আসনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পালাবদল হয়েছে অনেকবার। ৩টি উপজেলার ২০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত নওগাঁ-১। বিএনপির ঘাঁটি হিসাবে পরিচিতি এই আসন। ১৯৯১ সালে জয় পায় আওয়ামী লীগ এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে এই আসনটি বিএনপির দখলে থাকে। ২০০৮ সালে থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আসনটি ধরে রেখেছে। আওয়ামী লীগ আসনটি ধরে রাখতে চায় এবং বিএনপি চায় আসনটি পুনরুদ্ধার করতে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসনটি বিএনপি তাদের দখলে নিতে চায়। মামলা-হামলায় কাবু দলটির বেশ কয়েকজন নেতা এরই মধ্যে মাঠ গোছানোর কাজ করার পাশাপাশি প্রচার কাজেও নেমে পড়েছেন। বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে নানামুখী কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত করছেন। যোগ দিচ্ছেন সভা-সমাবেশ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। অনেকে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ফেসবুকে নির্বাচনী পরিকল্পনা তুলে ধরে পোস্ট দেয়াসহ এসএমএসের মাধ্যমেও নিজেকে তুলে ধরছেন অনেকে। নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর-পোশরা-সাপাহার) আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা হলেন, আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি খালেকুজ্জামান তোতা; নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মরহুর এনামুল হকের ছেলে, উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা রেজাউল হাসান রানা; বিএনপির সাবেক এমপি, কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য ডা. ছালেক চৌধুরী, জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান, সাপাহার উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আবদুর নূর ও পোরশা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির সদস্য শাহ আহম্মদ মোজাম্মেল চৌধুরী; জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ন আহবায়ক ও উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আকবর আলী কালু ও ইসলামী আন্দোলনের মোস্তাফিজুর রহমান। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘এ আসনে আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গত কয়েক বছরে স্কুল-কলেজ নির্মাণসহ এলাকায় অনেক উন্নয়ন করেছি। সাধারণ মানুষেরও আমার প্রতি আগ্রহ আছে, ব্যাপক জনসমর্থনও পাচ্ছি। আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে চাই। তিনি আরও বলেন, এলাকার উন্নয়ন তো একজন সংসদ সদস্যের দাঁড়ায় সব পরিচালিত হয়। আর আমি তো এখন বর্তমান মন্ত্রী। সে ক্ষেত্রে আমি তো উন্নয়ন কাজ করে যাচ্ছি। নির্বাচনে এলাকার উন্নয়নে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, গত কয়েক বছরে সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ করেছি। আঞ্চলিক সড়ক, গ্রামীণ সড়ক, ব্রিজ, কালভার্টসহ অবকাঠামোগত অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। আমার নির্বাচনী এলাকা সাপাহারে অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষনা করা হয়েছে। আগামীতে জবই বিলকে একটি পর্যটন শিল্প এলাকা গড়ে তোলার পরিকল্পনাও হাতে রয়েছে। আমি আবারও মনোনয়ন পেলে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করব। এলাকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। আশা করি আগামীতে আমি মনোনয়ন পাব এটা শতভাগ নিশ্চিত। খালেকুজ্জামান তোতা বলেন, মনোনয়ন পেয়ে জয়ী হলে এলাকার গণমানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কর্মসংস্থানের দিকে নজর দেব। একই সঙ্গে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখব। রেজাউল হাসান রানা বলেন, বর্তমান সরকার যেভাবে উন্নয়ন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাতে আগামী নির্বাচনে নৌকার বিজয় হবেই। আগামীতে নৌকার মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হলে সামগ্রিক উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখব। বিএনপি স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ডা. ছালেক চৌধুরী সমর্থকদের দাবি, এবার মনোনয়ন পাবেন তিনি। কথা হয় ডা. ছালেক চৌধুরী সঙ্গে। তিনি বলেন, ভালো কাজের জন্য ভালো পরিবেশ দরকার। একটি পক্ষকে দমনপীড়ন করে একতরফা নির্বাচন করলে দেশের মঙ্গল হবে না। দলীয় মনোনয়ন পেলে জনগণ আমাকে অতীতে যেভাবে সমর্থন করেছে, তাতে আমি নিশ্চিত ধানের শীষের বিজয় কেউ রুখতে পারবে না। আমার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া নেই। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাব।
বিএনপির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্রচর্চার জন্য আগে নিরপেক্ষ নির্বাচন দরকার। গণতন্ত্র না থাকলে ভালো কাজ করা কঠিন। আমি দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধানে কাজ করে যাব। জাতীয় পার্টির আকবর আলী কালু বলেন, অপরাজনীতির হাত থেকে রেহাই পেতে জাতীয় পার্টির শাসন দেখতে চায় জনগণ। তিনি বলেন, আশা করছি, আগামী নির্বাচনে ভোটে আমি বিজয়ী হব। ইসলামী আন্দোলনের মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তাদের একটি বিশাল ভোটব্যাংক আছে আসনটিতে। আগামী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসনটি ফিরে পেতে নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় রয়েছে। অনেকের ধারণা, নওগাঁ-১ আসনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি প্রার্থীর মধ্যেই মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তবে নির্ভর করছে সুষ্ঠ নির্বাচনের ওপর। এখানে মোট ভোটার ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৯১৬ জন। পুরুষ ভোটার ২ লাখ ২৩ হাজার ৩১৯ এবং নারী ভোটার ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৯৪ জন। উভয় লিঙ্গ ভোটার ৩জন। ১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নওগাঁ-১ আসনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ১৯ হাজার ১ শত ৫৮ জন। ভোট প্রদান করেন ১ লাখ ৪১ হাজার ৮ শত ৯৫ জন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আজিজুর রহমান মিয়া বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৫৪ হাজার ৮শত ৩ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সালেকুর রহমান। দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে তিনি পান ৪১ হাজার ৪ শত ৭৯ ভোট। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির শাসনামলে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে বিএনপি, ফ্রিডম পার্টি এবং কিছু নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল, অখ্যাত ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। বিএনপির ডা. মোহাম্মদ ছালেক চৌধুরী বিজয়ী হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী নাজির উদ্দিন আহমেদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ সহ সব বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জন করে।
এই সংসদের মেয়াদ ছিল মাত্র ১১ দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ হওয়ার পর সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ই জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ২০ হাজার ৩শত ৫৪ জন। ভোট প্রদান করেন ১ লাখ ৭৮হাজার ৮ জন। নির্বাচনে বিএনপির ডা. মোহাম্মদ ছালেক চৌধুরী বিজয়ী হন। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ৭০ হাজার ৪১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধন চন্দ্র মজুমদার। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ৫৯ হাজার ৯ শত ৭৫ ভোট। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ২ লাখ ৭১ হাজার ৩ শত ৬ জন। ভোট প্রদান করেন ২ লাখ ৩৭ হাজার ২শত ৪ জন। নির্বাচনে বিএনপির ডা. মোহাম্মদ ছালেক চৌধুরী বিজয়ী হন। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ২৯ হাজার ৮ শত ৯ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধন চন্দ্র মজুমদার। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ১ হাজার ১ শত ৩৫ ভোট। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৩ লাখ ১৩ হাজার ৩ শত ৩২ জন। ভোট প্রদান করেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ৯ শত ৭৫ জন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাধন চন্দ্র মজুমদার বিজয়ী হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ৭৭ হাজার ২ শত ৫১ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির ডা. মোহাম্মদ ছালেক চৌধুরী। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি তিনি পান ১ লাখ ১১ হাজার ৮৯ ভোট। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাধন চন্দ্র মজুমদার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীয় নির্বাচিত হন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৪ লাখ ২ হাজার ৬শত ৬৯ জন। ভোট প্রদান করেন ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৭ শত ৯৬ জন। নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন ৫ জন। নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের সাধন চন্দ্র মজুমদার, ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপির মোস্তাফিজুর রহমান, লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির আলী আকবর, হাত পাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মোস্তাফিজুর রহমান, মই প্রতীকে বাসদের মঙ্গল কিস্কু প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাধন চন্দ্র মজুমদার নির্বাচিত হন। নৌকা প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ৮৭ হাজার ২ শত ৯০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির মোস্তাফিজুর রহমান। ধানের শীষ প্রতীকে তিনি পান ১ লাখ ৪২ হাজার ৫৬ ভোট। কারচুপির অভিযোগে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচন বর্জন ও ফলাফল প্রত্যাখান করে।