বেতন ও পদ বৈষম্য দূর করার দাবিতে এবার সরকারি কর্মচারীদের বৃহৎ কয়েকটি সংগঠন একসঙ্গে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে করোনা পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তারা এক কাতারভুক্ত হওয়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। গত দু’মাসে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদ ও সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনের ব্যানারে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ৬টি ইউনিট বৈঠকে মিলিত হয়েছেন নেতারা। শিগগিরই বিভাগীয় পর্যায়ে সফর শুরু করাসহ সার্বিক কর্মসূচি ঠিক করতে কাল সোমবার যৌথ মিটিং আহ্বান করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদের সভাপতি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী নিজামুল ইসলাম ভূঁইয়া মিলন শনিবার জানান, কয়েকটি বৃহৎ কর্মচারী সংগঠনের সমন্বয়ে জানুয়ারি থেকে তাদের এক প্ল্যাটফরমে কর্মসূচি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে সেটি বেশ কয়েক মাস পিছিয়ে গেছে। তিনি বলেন, কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত বেশকিছু দাবিদাওয়া নিয়ে কথা বলা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেজন্য সোমবার বিকালে তারা যৌথ মিটিং আহ্বান করেছেন।
ডাক ভবনে অবস্থিত পোস্টাম্যান কর্মচারী ইউনিয়ন কার্যালয়ে আয়োজিত এ বৈঠক থেকে একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হবে। ওই কমিটি পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করাসহ একটি অভিন্ন দাবিনামাও প্রস্তুত করবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিগগির আমরা সংবাদ সম্মেলন করে আমাদের কর্মসূচি জানিয়ে দেব। তবে এ মাসের যে কোনো সময় থেকে ৮টি বিভাগে তারা সফর শুরু করবেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিভাগীয় পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে দাবি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া হবে। তবে তারা সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি দেবেন না। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলাও হবে না। নিয়মের মধ্যে থেকে তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলোকে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কাছে নিয়ে যাবেন।
সূত্র জানায়, সোমবারের বৈঠকে সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদ, সরকারি কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশন এবং ১১-২০তম গ্রেড কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ থেকে ৫ জন করে কেন্দ্রীয় নেতা যোগ দেবেন। এ বৈঠকের প্রধান উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে কর্মচারী সংহতি পরিষদের মহাসচিব ও ডাক বিভাগের কর্মচারী নেতা আমজাদ আলী খান এবং কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ও প্রাথমিক গণশিক্ষা অধিদফতরের কর্মচারী নেতা খায়ের আহমেদ মজুমদার বলেন, কর্মচারীদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হল বেতন ও পদ বৈষম্য। তাই এই সংকটের উত্তরণ ঘটানোই তাদের মূল এজেন্ডা। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক কিছু যৌক্তিক দাবিদাওয়া যুক্ত হবে। তারা বলেন, সারা দেশের সরকারি কর্মচারীদের পরিচয় এক হলেও নানা কারণে সচিবালয়ের কর্মচারীরা পদ ও বেতনের দিক থেকে বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা বেশি ভোগ করছেন। যেমন- সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (পিও) পদ দুটি ১৯৯৮ সালের আগে যথাক্রমে ছিল শাখা সহকারী ও স্টেনোগ্রাফার। সচিবালয়ের বাইরে তৃতীয় শ্রেণির এ দুটি পদের নাম উচ্চমান সহকারী ও স্টেনোগ্রাফার। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, ২২ বছর আগে সচিবালয়ের এই সব পদে থাকা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা পৃথক নিয়োগবিধির মাধ্যমে আপগ্রেডেশন হয়ে রাতারাতি দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হয়ে যান। পরবর্তী সময়ে তাদের কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়ে নন-ক্যাডার কোটায় সহকারী সচিব কিংবা সিনিয়র সহকারী সচিব হয়েছেন। কিন্তু একই সঙ্গে একই যোগ্যতা নিয়ে চাকরিতে প্রবেশ করেও দফতর সংস্থায় কর্মরতদের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। তারা তৃতীয় শ্রেণির পদে পড়ে আছেন। তারা বলেন, ৩৩ বছর একই পদে চাকরি করছেন। কিন্তু কোনো পদোন্নতি নেই। পদ না থাকায় পদোন্নতিও হচ্ছে না। কেউ কেউ একেবারে চাকরির শেষদিকে এসে সিনিয়র পদের কেউ অবসরে গেলে স্বল্প সময়ের জন্য পদোন্নতি পান। তারা বলেন, এভাবে এক রকম ব্লক পদে থেকে তাদের পুরো চাকরিজীবন পার করতে হচ্ছে। এছাড়া পদোন্নতি না হওয়ায় পদ আপগ্রেডেশন ও বেতন সেভাবে বাড়ছে না। উপরন্তু মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড না থাকা। এজন্য বৈষম্য দূরীকরণই তাদের অন্যতম দাবি। এর পরে থাকছে দশম গ্রেডের বেতন স্কেল প্রণয়ন, যা বঙ্গবন্ধু করেছিলেন। এছাড়া শতভাগ পেনশন সুবিধা প্রদানও তাদের বড় একটি দাবি।
প্রসঙ্গত, সরকারি কর্মচারীদের দাবি বাস্তবায়নে সরকারি কর্মচারী সংহতি পরিষদ ঐতিহ্যবাহী বৃহৎ সংগঠন। এরশাদ সরকারের সময়ে ১৯৮৮ সালে এ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ পর্যন্ত কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ যত দাবি বাস্তবায়ন হয়েছে, তার বেশির ভাগ এ সংগঠনের মাধ্যমে হয়েছে। সংগঠনটির প্রথম সভাপতি ছিলেন রাষ্ট্রপতি সচিবালয়ের শাখা সহকারী সৈয়দ মহিউদ্দিন এবং মহাসচিব এজি অফিসের কর্মচারী নেতা কাজীমুদ্দিন। নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চে বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনে এই সংগঠনের ভূমিকা ছিল প্রকাশ্যে। যে কারণে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সংগঠনটির কার্যক্রম এক রকম বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন করে এর যাত্রা শুরু হয়। সচিবালয়সহ বিভিন্ন দফতরে শাখা কমিটি রয়েছে কর্মচারী সংহতি পরিষদের। বর্তমানে লিখিত ১২ দফা দাবি নিয়ে কাজ করছেন সংগঠনের নেতারা। এ বিষয়ে জনমত তৈরি করতে তারা লিফলেট ও পোস্টার ছেপে প্রচারণার কাজ করেছেন। অপরদিকে কর্মচারী কল্যাণ ফেডারেশনও সচিবালয়ের বাইরে বৃহৎ সংগঠন। দফতর সংস্থাসহ এর অধীনস্থ মাঠপর্যায়ের সব কর্মচারীর দাবিদাওয়ার কথা বলে ফেডারেশন। ৭ দফা দাবি আদায়ে এই সংগঠনের নেতারা ২০১৫ সাল থেকে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। পাশাপাশি কর্মচারী উন্নয়ন পরিষদ নামে আরও একটি সংগঠনের এই প্ল্যাটফরমে শামিল হওয়ার কথা রয়েছে।
সচিবালয় সমবায় সমিতির ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের স্বার্থগত দ্বন্দ্ব নিয়ে দুই দশক ধরে সচিবালয়ে সরকারপন্থী কর্মচারী নেতারা নিজেরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত। যে কারণে সাধারণ কর্মচারীদের দাবির পক্ষে সত্যিকারার্থে সবাই সমস্বরে কখনও কথা বলতে পারেননি। সচিবালয়ের বাইরেও প্রায় একই অবস্থা। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন সে দলের অনুসারী হিসেবে বহু নেতার আবির্ভাব ঘটে। বেশির ভাগ নেতাই নিজের পকেট ভারী করার কাজে ব্যস্ত থাকেন। যে কারণে ওই অর্থে কাজের কাজ কিছুই হয় না। তাই সাধারণ কর্মচারীরা কর্মচারী নেতাদের নিয়ে সব সময় আস্থাহীনতায় ভোগেন। এজন্য তারা অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে সচেতনভাবে সবকিছু মূল্যায়নের চেষ্টা করছেন। তারা মনে করেন, দল এবং ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে কে কতক্ষণ মাঠে টিকে থাকতে পারবেন, সেটিই দেখার বিষয়।