বাংলাদেশ ১৬-২০ গ্রেড সরকারি কর্মচারী সমিতির ৯ দফা দাবি আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
করোনা মহামারী শুরু হওয়ার আগে গত জানুয়ারি মাসে সমিতির নেতারা অর্থমন্ত্রী, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে লিখিত আবেদন জমা দেন।
এরপর সংবাদ সম্মেলন করে দাবির সপক্ষে তাদের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। কিন্তু অদ্যাবধি সরকারের তরফ থেকে তারা কোনো সদুত্তর পাননি। তবে অফিসপাড়া স্বাভাবিক হতে শুরু করায় এখন তারা দাবির বিষয়টি পুনরায় জোরেশোরে সামনে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মঙ্গলবার এমন প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ এবং ১৬-২০ গ্রেড সরকারি কর্মচারী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী।
সরকারি দল সমর্থক হিসেবে পরিচিত এই কর্মচারী নেতা বলেন, বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ৭ জানুয়ারি বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও সচিবের কাছে সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে ৯টি দাবি তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্বকারী সবচেয়ে বড় সংগঠনের দাবি হওয়া সত্ত্বেও সরকারের তরফ থেকে ন্যূনতম সহানুভূতি কিংবা প্রত্যুত্তর জানানো হয়নি।
এতে তাদের সংগঠনের নেতারাসহ সাধারণ কর্মচারীরা মনে আঘাত পেয়েছেন। তবে এ কথাও সত্য যে, আমরা দাবি জানানোর দেড় মাসের মধ্যে দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরু হয়ে যায়। সবকিছু প্রায় ৩ মাস স্থবির ছিল।
গত কিছুদিন থেকে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তাই তারা তাদের দাবিগুলো নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান। এজন্য কোনোরকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ ছাড়াই আমরা কিছু কর্মসূচি দেব।
তিনি বলেন, যেহেতু ১৬-২০ গ্রেড ছাড়াও সম্প্রতি আমাকে সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেহেতু সবাইকে নিয়ে বৈঠক করে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, ৯ দফা দাবি সংবলিত দুই পৃষ্ঠার আবেদনপত্রটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, অর্থমন্ত্রী আ. হ. ম. মোস্তফা কামাল, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুনের দফতরে একযোগে জমা দেয়া হয়।
এরপর জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দাবিগুলোর যৌক্তিকতা তুলে ধরেন ১৬-২০ গ্রেড সরকারি কর্মচারী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী ও সাধারণ সম্পাদক আবু সায়েমসহ অন্য নেতারা।
নয় দফা দাবিতে যা আছে : অন্যতম দাবির মধ্যে দ্রব্যমূল্যের বাজার দর বিবেচনায় নিয়ে ৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধিসহ ৫ বছর পূর্তিতে ৯ম পে-কমিশন গঠন করা। কেননা বিদ্যমান পে-স্কেলের মেয়াদ প্রায় ৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এর মধ্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বহুগুণ বেড়েছে।
দ্বিতীয়ত, সিলেকশন গ্রেড বা টাইম স্কেল পুনর্বহাল করে আগের নিয়মে চাকরির ৪, ৮ ও ১২ বছরে প্রদান নিশ্চিত করা। এ বিষয়ে তাদের যুক্তি ছিল- টাইম স্কেল সিলেকশন গ্রেড না থাকায় নিচের স্তরে, বিশেষ করে ১১ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরমভাবে বেতন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। কেননা বিদ্যমান পে-স্কেলে বেতন বাড়ানো হলেও বৈষম্যের ব্যবধান আকাশছোঁয়া।
প্রথম গ্রেডের সঙ্গে ২০তম গ্রেডের ব্যবধান ১০ গুণ। অর্থাৎ উপরে প্রায় ৮০ হাজার এবং নিচে ৮ হাজার টাকা। এছাড়া টাইম স্কেল সিলেকশন গ্রেড না থাকায় তাদের আগে যেভাবে উচ্চতর স্কেলে প্রবেশ করে বেতন বৃদ্ধির সুযোগ ছিল তাও রহিত করা হয়েছে। এজন্য ৯ম পে-স্কেলে তারা এর কার্যকর সমাধান চান।
তৃতীয়ত, ৫০ শতাংশ পেনশন বাধ্যতামূলকভাবে সরকারের কাছে জমা রাখতে চান না সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কেননা তাদের মতে, চাকরিজীবন শেষে বড় বড় কর্মকর্তাদের অনেকের হয়তো পেনশনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না, কিন্তু সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে পেনশনের টাকায় শেষ সম্বল। তাই ৫০ ভাগ টাকা নিয়ে অনেকের পক্ষে চাকরিবিহীন অবসর জীবনে সংসার পরিচালনা করা সম্ভব হবে না।
তাছাড়া ওই সময় ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়াসহ ফ্ল্যাট কেনা কিংবা বাড়ি করার বিষয়গুলো জরুরি হয়ে পড়ে। যারা সারাজীবন চাকরি করে একটি বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারেন না, তাদের পেনশনের টাকার ওপর শেষ ভরসা করতে হয়। একজন সাধারণ কর্মচারী পেনশন ও আনুতোষিক ল্যাম্পগ্রান্ড মিলে ১৭-১৮ লাখ টাকা পান।
কিন্তু সেখান থেকেও যদি ৫০ ভাগ সরকারের কাছে রেখে দিতে হয়, তাহলে ওই টাকা দিয়ে তিনি কিছুই করতে পারবেন না। এছাড়া পেনশন বা আনুতোষিক হার ৯০ হতে ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে এবং পেনশন হার ২৩০ টাকা হতে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করাও সময়ের দাবি।
চতুর্থত, সুদবিহীন গৃহনির্মণ ঋণ এবং বর্তমান ব্যাংকিং প্রথায় ঋণ প্রদান সহজীকরণ করা। ব্যাংকের কর্মচারীরা যেভাবে পেয়ে থাকেন। তাদের দাবিনামায় বলা হয়, কর্মচারীদের জন্য আগে যার যার মন্ত্রণালয় থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা গৃহনির্মাণ ঋণ দেয়া হতো।
যা গ্রহণ ও পরিশোধ করা সহজ ছিল। যদিও ওই টাকায় এখন আর বাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যাংকিং পদ্ধতিতে ঋণ সুবিধার যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে তা অনেক জটিল ও দুর্লভ।
জমি কিনে সেখানে বাড়ি নির্মাণ খাতে ১০ শতাংশ বিনিয়োগ করে ঋণ নেয়া অনেকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া কর্মচারীরা বেতনের বিপরীতে যে ঋণ পাবে তা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনা তো দূরের কথা, ভালোভাবে একটি বাড়ি করাও অসম্ভব। তাছাড়া ঋণ পরিশোধ না করে অবসরে গেলে ১০ শতাংশ সুদ দেয়ার বোঝাও চাপবে। মূলত এই ঋণ নীতিমালা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ক্যাডার কর্মকর্তা ছাড়া সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পক্ষে ঋণ পাওয়া খুবই কঠিন।
কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কেনার পর তা চাকরিজীবনের মধ্যেই পরিশোধ করতে পারবে। কিন্তু কর্মচারীরা তা পারবে না। তাছাড়া দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা হলে তো কথাই নেই। দুর্নীতির টাকায় নিকটাত্মীয়ের নামে কেনা ফ্ল্যাট এ সুযোগে সহজে জায়েজ করা যাবে।
পঞ্চম, ব্লক পদ বিলুপ্ত করে শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা। যেমন- নোটিশ সার্ভার, ডিআর, মালী, নিরাপত্তা প্রহরী এবং প্লেন পেপার কপিয়ারসহ সব ব্লক পদে জরুরি ভিত্তিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা।
ষষ্ঠ, আউটসোর্সিং নিয়োগ প্রথা বাতিল করা। কেননা এর ফলে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় ছাড়া ভালো কিছু হচ্ছে না। এছাড়া নিয়োগ ও বেতন পরিশোধের মধ্যে ঠিকাদার নামক মধ্যস্বত্বভোগী ঢুকে পড়েছে।
ফলে একজন আউটসোর্সিং কর্মচারীর অনুকূলে সরকার ১৬ হাজার টাকা পরিশোধ করলেও বাস্তবে তারা হাতে পাচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। বাকি টাকা কমিশনের নামে হাওয়া হয়ে যায়। এটিই বাস্তবতা। তাছাড়া আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সরকারি অফিসের গোপনীয়তা রক্ষা করার নিশ্চয়তা থাকে না।
সপ্তম, সুপ্রিমকোর্ট, পুলিশ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বাংলাদেশ রেলওয়ের মতো সরকারি সব প্রতিষ্ঠানে ৩০ শতাংশ মহার্ঘ পোষ্য কোটা চালু করা জরুরি।
অষ্টম দাবির মধ্যে রয়েছে, কর্মকর্তাদের মতো রাজধানীতে প্রতীকী মূল্যে ‘কর্মচারী ক্লাবের’ জন্য সরকারি জমি বরাদ্দ করা। এটি তাদের দীর্ঘদিনের দাবি। যাতে কর্মচারীদের বৃহত্তর কল্যাণে ক্লাব ব্যবহার করা যায় সেজন্য তারা এ দাবি আদায়ে অনেক বেশি তৎপর।
সবশেষে নবম দাবির মধ্যে রয়েছে, সচিবালয়ে জাতির পিতার নামে ভাস্কর্য ও প্রধানমন্ত্রীর নামে দৃষ্টিনন্দন তোরণ ও কর্নার স্থাপন করা। গত মার্চ মাসে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার কথা থাকলেও করোনা সংকটের কারণে সেটি বেশিদূর এগোতে পারেনি।