সাগর ও নদীর ভয়াবহ ভাঙনের ফলে ছোট হয়ে আসছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন তীব্র ভাঙনের কবলে পড়েছে। সম্প্রতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে ভাঙনের তীব্রতা। অব্যাহত ভাঙনে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে বনের স্থলভাগের আয়তন।আধুনিক বিশ্বে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার পর্যটন।বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন ঘিরে বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের বিকাশে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। এই বনের সৌন্দর্য দেখতে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা। চরম ঝুঁকিতে রয়েছে বঙ্গোপসাগর ও নদ-নদী তীরবর্তী পূর্ব বন বিভাগের ১৪টি স্থাপনা ও কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র (সাইক্লোন শেল্টার)। এছাড়া ইতিমধ্যেই বিলিন হয়ে গেছে বহু স্থাপনা। ঝুঁকিতে থাকা এসব স্থাপনার মধ্যে রয়েছে চারটি স্টেশন ও ১০টি টহল ফাঁড়ির পাকা অফিস ভবন ও ঘর, দুর্যোগের সময় বনকর্মী ও জেলেদের নিরাপদে থাকার জন্য দু’টি আশ্রয়কেন্দ্রও। এছাড়া দেশি-বিদেশি ফ কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান করমজল বন্যপ্রাণি প্রজনন কেন্দ্র, কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্র ও জামতলা সমুদ্র সৈকত (সী-বিচ) উল্লেখযোগ্য। সরেজমিন ও বিভিন্ন স্টেশনের বন কর্মকর্তাদের সাথে আলাপকালে মিলেছে এমন চিত্র। এদিকে পর্যটকেরা জামতলা সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে একই সঙ্গে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের যে নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করতো সেই জামতলা সৈকতও ভাঙনের কবলে পড়ে বঙ্গোপসাগরে প্রায় বিলিন হয়ে গেছে। ভাঙনে সৌন্দর্য হারিয়েছে কটকার ঝাউ বন ও হরিণের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র কেওড়া বনেরও। ফলে ভাঙনে দর্শনীয় এসব স্থানগুলোর সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ায় সুন্দরবন ভ্রমণে পর্যটকদেরও আগ্রহ কমছে দিন দিন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে ভাঙন এখন অনেক বন অফিসের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি অফিসের পাকা ভবন, বড় বড় পুকুর ও ব্যাপক বনভূমি বিলিন হয়ে গেছে নদী-সাগরে। অনেক অফিস কয়েক দফা স্থানান্তর করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। প্রতিনিয়ত আতঙ্কে দিন কাটছে ঝুঁকিপূর্ণ এসব স্টেশন ও টহল ফাঁড়িতে কর্মরত বনকর্মীদের। ভাঙনরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহায়তা চাওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে বন বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ও ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনে দেখা দিয়েছে ভাঙনের এমন ভয়াবহতা। এভাবে ভাঙনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে থাকলে একসময় অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাস ভূমি ও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সুন্দরবন (বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা)। বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, জীববৈচিত্র্যের আধার এই সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ৫১৭বর্গ কিলোমিাটার। এরমধ্যে স্থল ভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪২ দশমিক ৬ বর্গ কিলোমিটার। আর জল ভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৪ দশমিক এক বর্গ কিলোমটার। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাহমান ৪০০ টি ছোট-বড় নদ-নদী ও খাল। সুন্দরবন সংলগ্ন সমুদ্র এলাকার পরিমাণ এক হাজার ৬০৩ দশমিক ২বর্গ কিলোমিটার। বিশ্বের এই বৃহৎ জলাভূমি আন্তর্জাতিকভাবে ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে স্বীকৃত। এছাড়া পৃথিবীর বৃহত্তম এই ম্যানগ্রোভ বনে রয়েছে ১৮৪ প্রজাতির গাছপালা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও মায়াবি চিত্রল হরিণসহ ৪৫৩ প্রজাতির বন্যপ্রাণি এবং ২৯২ প্রজাতির মৎস্য ও জলজ প্রাণি। সাগর-নদীর তীব্র ভাঙনের মুখে যা এখন পড়েছে চরম অস্তিস্ব সংকটে। বঙ্গোপসাগর ও বনের নদ-নদীর তীব্র ভাঙনের কবলে পড়া বন অফিসগুলো হচ্ছে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের শুঁটকি পল্লীখ্যাত দুবলার চর, শ্যালারচর, আলোরকোল, কোকিলমুনি টহল ফাঁড়ি, বগী স্টেশন, শরণখোলা স্টেশন, কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্র, কচিখালী অভয়ারণ্য স্টেশন, চান্দেশ্বর টহল ফাঁড়ি এবং চাঁদপাই রেঞ্জের ঝাঁপসি টহল ফাঁড়ি, শুয়ারমারা টহল ফাঁড়ি, জোংড়া টহল ফাঁড়ি, হারবাড়িয়া স্টেশন ও করমজল বন্যপ্রাণি প্রজনন ও পর্যটন কেন্দ্র। শরণখোলা রেঞ্জের বগী স্টেশন কর্মকর্তা মোঃ আব্দুস ছবুর বলেন, প্রায় ১০ বছর ধরে ভাঙনের কবলে তাদের স্টেশন। এ সময়ের মধ্যে একটি দোতলা পাকা ভবন, একটি কাঠের ঘর, বিশাল একটি পুকুরসহ কয়েক একর বনভূমি নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। এরপর নতুন করে নির্মিত অফিস ভবনটিও ফের ভাঙনের মুখে। ভাঙন খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হচ্ছে আমাদের। কটকা অভয়ারণ্য কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সরজিত চৌধুরী বলেন, কটকার অবস্থান বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। যেকারণে ভাঙনের প্রবণতা এখানে একটু বেশি। ইতিমধ্যে তিনটি অফিস ভবন, একটি গেস্ট হাউজ, অফিসের সামনের ঝাউবন, পশ্চিম দিকের হরিণ বিচরণের কেওড়া বন, একটি ফুট ট্রেইল এবং জেটি ধ্বংস হয়ে গেছে। জামতলা সমুদ্র সৈকতও প্রায় বলিন। কয়েক বছর আগে ভাঙনরোধে জিও ব্যাগে বালু ভরে ডাম্পিং করা হলেজ তা কাজে আসেনি। ভাঙন অব্যাহত থাকায় সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। পর্যটকরা অনেক আশা নিয়ে ভ্রমণে এসে আশাহত হচ্ছেন। দুবলা জেলেপল্লী (শুঁটকি পল্লী) টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ খলিলুর রহমান বলেন, দুবলা অফিসটি বলতে গেলে এখন সাগরের মধ্যে রয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে আমরা দাপ্তরিক কাজ করছি। এছাড়া দু’টি আশ্রয়কেন্দ্র ভাঙনের মুখে রয়েছে। খুলনার পর্যটন ব্যবসয়ী মেহেদী ট্যুর’স এর সিইও শাহেদী ইসলাম রকি বলেন, পর্যটকদের কাছে সুন্দরবনের সবচে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে শরণখোলা রেঞ্জের কটকা, জামতলা সমুদ্র সৈকত, কচিখালী, আলোরকোল অন্যতম। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ভাঙনের ফলে সেখানকার সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। পর্যটকরা এবছর যে দৃশ্য দেখে, পরের বছর গিয়ে তা আর দেখতে পান না। যে কারণে তারা দ্বিতীয়বার ভ্রমণের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এতে আমাদের পর্যটন ব্যবসায়ও নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করছি। ভাঙনরোধে সরকারে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। মোংলার চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল বন্যপ্রাণি প্রজনন ও পর্যটন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, পশুর নদীর ভাঙনে অনেক ঝুঁকির মধ্যে আছে পর্যটন কেন্দ্রটি। আমাদের টিকিট কাউন্টার ভবনটি বেশি ঝুঁকিতে আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করেও তা কাজে আসেনি। বিশেষ করে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ পশুর নদী ড্রেজিং করায় ভাঙনের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে ভাঙন চলতে থাকলে ৫-৬ বছরের মধ্যে অফিস ভবন, ফুট ট্রেইলসহ অনেক স্থাপনা নদীতে বিলিন হয়ে যাবে।পর্যটকরা বলছেন, পর্যটনের ক্ষেত্রে অপার সম্ভাবনা থাকলেও দীর্ঘদিনেও পর্যটকদের জন্য বাড়েনি সুযোগ-সুবিধা। এ ছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসা, রাতে অবস্থান, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনও নিশ্চিত হয়নি। সুন্দরবনের সড়কপথে চলাচলের তেমন কোনও ভালো ব্যবস্থা নেই। বনের ভেতর ঘুরে দেখার জন্য ওয়াকওয়ের অবস্থা তেমন ভালো না। এসব কারণেই ঠিক ওভাবে পর্যটক টানতে পারছে না সুন্দরবন। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, যেহেতু সুন্দরবনের প্রতিবেশ, পরিবেশ ও ইকোসিস্টেম অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাই এখানে ইকোট্যুরিজমের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ প্রয়োজন। যা তৈরিতে পর্যটন সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে পর্যটনশিল্পের বিকাশে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জীববৈচিত্র্যের প্রাণ-প্রাচুর্যের কারণে সুন্দরবন পৃথিবীর অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্র থেকে স্বতন্ত্র। এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের নাম। এ ছাড়া বনে আছে নানা ধরনের পাখি, চিত্রাল হরিণ, কুমির, ডলফিনসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণী। তাই সুন্দরবন ঘিরে গড়ে তুলতে হবে ইকোট্যুরিজম। তবেই এটি বিনোদনের পাশাপাশি গবেষণার স্থান হয়ে উঠবে। বাড়বে প্রসার। পরিবেশবিদরা বলছেন, সুন্দরবনকেন্দ্রিক পর্যটনকে যদি সুন্দর করে নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিচালনা করা যায় তাহলে এটি বিরাট সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হবে। এ ছাড়া সুন্দরবনে পর্যটককেন্দ্রিক যেসব নৌযান আছে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা করা গেলে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে না। তখন পর্যটকদের কাছে সুন্দরবন ভ্রমণ আরও আনন্দের হবে। পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) শেখ মাহাবুব হাসান বলেন, বছরখানেক ধরে ভাঙনের প্রবণতা বেশি। সাগর ও নদী ভাঙন এতোটাই ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করেছে যে কয়েটি বন অফিস রক্ষা করা সম্ভব হবে না। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মোহাম্মদ নূরুল করিম বলেন, সুন্দরবনের স্থল ভাগ সমুদ্র ও নদী ভঙনের স্থানে আমরা ভাঙা নৌকা ডুবিয়ে রেখে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। বন বিভাগের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেও ভাঙনের বিষয়টি জানানো হয়েছে। সুন্দরবনের স্থল ভাগের এই ভাঙন দ্রুত প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা চলছে।