চা-বাগানে এখন ভরা মৌসুম। এবার ১০২ মিলিয়ন কেজি চা-পাতা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে বাগানে বাগানে ব্যস্ত সময় পার করছেন চা-শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টরা। এবারে মৌসুমের প্রথম দিকেৎ তীব্র খরা, অতিবৃষ্টি নিয়ে বাগানগুলো মন্দা সময় পার করে। তবে গত কয়েক মাসের বৃষ্টিতে চা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আশাবাদী বাগান সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে বাগান থেকে তুলে আনা চা-পাতা কারখানাতেই পচে নষ্ট হওয়ার উপক্রম। চায়ের গুণাগুণও নষ্ট হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানার যন্ত্রপাতির ক্ষতি হচ্ছে। এতে চা-শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চায়ের এই ভরা মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রয়োজন। নতুবা সম্ভাবনাময় এই কৃষি পণ্যের বাজার নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাগান কর্মকর্তারা জানালেন, এবার চায়ের নিলাম বাজারে কাঙ্ক্ষিত দাম ওঠেনি। এতে অনেক চা-বাগানকে লোকসান গুণতে হবে। তারা বলেন, ‘কেজি প্রতি ২০০ টাকা বা তার ওপরে দাম না উঠলে পোষায় না।’ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত নিলাম বাজারে সর্বোচ্চ ১৮০ টাকা ও সর্বনিম্ন ১৩০ টাকা কেজি দরে চা বিক্রয় হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেটের একজন চা-বাগান ম্যানেজার বলেন, এবার চায়ের উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ২৫০ টাকা পড়বে। বিদ্যুৎ বিপর্যয়সহ নানা কারণে এমনটি হবে। চা-মৌসুম শুরু হয় মার্চ মাসে। মৌসুমের শুরুর বৃষ্টিকে ‘আশীর্বাদ’ বলে মনে করেন বাগান সংশ্লিষ্টরা । কিন্তু এবার মার্চে কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি হয়নি বলে মন খারাপ ছিল বাগানিদের। তার পরও বাগান শ্রমিকরা রুটিন মাফিক চা-পাতা ‘চয়ন’ (চা-পাতি তোলা) শুরু করেন ভবিষ্যতের আশায়। মূলত মার্চের বৃষ্টিতে চা-গাছে কুঁড়ি আসতে শুরু করে । নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত পাতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তবে সর্বোচ্চ চা উৎপাদন হয় জুলাই ও আগস্ট মাসে। এবার মৌসুমের শুরুতে অসম্ভব গরমে বাগানে বাগানে দেখা গেছে ‘রেড স্পাইডার’ ও ‘হেলোফিলিটস মশা’র আক্রমণ। বার বার এমন বিপর্যয়ে বাগানের মালিক শ্রমিকরা পড়েন মহা দুশ্চিন্তায়। তবে এপ্রিলের শেষ দিকে বৃষ্টির দেখা মেলে এবং মে মাসের বৃষ্টি নতুন করে আশার সঞ্চার করে। আর জুনে প্রচুর বৃষ্টি চা-বাগানকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। কুলাউড়ার ফুলবাড়ী ও নূর জাহান চা-বাগানের জিএম লুৎফুর রহমান চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, ‘চায়ের বাজার রক্ষায় উন্নতমানের পাতা তৈরি করতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ‘আমাদের দুটি বাগানে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১০ লাখ ৫০ হাজার কেজি। গত মাস পর্যন্ত বাগানের উৎপাদন ছিল ৫ লাখ কেজির উপরে। তবে লোডশেডিংই বড় সমস্যা,’। বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. ইসমাইল হোসেন জানান, এবার চায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০২ মিলিয়ন কেজি। তিনি বলেন, চলমান চায়ের মৌসুমে জুন মাসের প্রথম দিকে চা-শিল্প প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে পড়ে। বৃষ্টিপাত কম হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে চা-বোর্ডের চেয়ারম্যানের নির্দেশে বিভিন্ন পরামর্শ প্রদান করা হয় এবং পানি সেচের মাধ্যমে উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়। তিনি আরো জানান, চলতি মৌসুমে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে সমন্বিতভাবে তারা কাজ করছেন। শ্রীমঙ্গল ভাড়াউড়া চা-বাগানের চা-শ্রমিক পারবতী গৌঢ় জানান, এখন বেশি বেশি পাতা তুলছেন। এজন্য বেশি পারিশ্রমিকও পাচ্ছেন। বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের পরিচালক ড. রফিকুল হক জানান, চা উৎপাদনের বর্তমান ভরা মৌসুমে আশানুরূপ উৎপাদন হচ্ছে। সূত্র জানায়, এ বছর আগস্টের উৎপাদন ৫০ মিলিয়ন কেজি ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে চা উৎপাদন হয় ১১ দশমিক ২৭৬ মিলিয়ন কেজি। আর আগস্টে হয় ১০ দশমিক ৭৬২ মিলিয়ন কেজি। সংশ্লিষ্টরা জানায়, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০২ মিলিয়ন কেজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তারা আশাবাদী। বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের নর্থ সিলেট ভ্যালির চেয়ারম্যান নোমান হায়দার চৌধুরী শনিবার ইত্তেফাককে বলেন, ‘বিদ্যুৎ সরবরাহসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালো থাকলে আশা করি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছা সম্ভব হবে। সূত্র মতে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে ১৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে ১৩০ মিলিয়ন কেজি চা দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ করা হবে। বাকি ১০ মিলিয়ন কেজি চা বিদেশে রপ্তানি করা হবে। উল্লেখ্য, সারা দেশের ১৬৭ টি চা-বাগানের মধ্যে সিলেটেই আছে ১৩৬টি।