সোনালি আঁশ (পাট) বাংলাদেশের অন্যতম মূল্যবান অর্থকরী ফসল। আমাদের দেশের মতো এত ভালো মানের পাট পৃথিবীর আর কোথাও উৎপন্ন হয় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার একাধিক ভাষণে উল্লেখ করেছেন, পাট সম্পদ থেকে আয় করা বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের প্রাপ্য, তা থেকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা আমাদের বঞ্চিত করছে। লড়াই করে আমাদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে।
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি আগুন লাগে পাটের গুদামগুলোতে। কারণ, পাটকে ধ্বংস করে দিতে পারলে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে ব্যর্থ হবে। বঙ্গবন্ধু সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্র এ কাজটি করেছিল। পাটকলগুলোকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে তখন থেকে বিভিন্ন চক্রান্ত চলছে।
যেসব পাটকল স্বাধীনতার আগে লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল, স্বাধীনতার পর সেই পাটকলগুলো কেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল- এর কারণ ও প্রতিকারে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। মাথা-ভারি প্রশাসনের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পাটকল আদমজী বন্ধ করে দেয়া হয়। সরকারিভাবে বলা হল, অব্যাহত লোকসানের কারণে আদমজী বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।
মাথাব্যথা হলে কি মাথা কেটে ফেলতে হয়, নাকি মাথাব্যথার চিকিৎসা করাতে হয়? আদমজী বন্ধের কারণে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। আদমজী বন্ধের প্রতিবাদে পাটকল শ্রমিকদের বাঘা বাঘা নেতার ভূমিকা জোরালো ছিল না। আদমজী বন্ধের পর যা রইল সরকারের হাতে, সেগুলোর অবস্থাও দিন দিন রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হতে থাকে। অবশেষে সরকারি সব পাটকল বন্ধ ঘোষণা করল বর্তমান সরকার।
এ সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে পাটকল শ্রমিক সংগঠন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তারা বলেছেন, যে টাকা খরচ হবে পাটকল বন্ধ করতে, সেই টাকা দিয়ে পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করা যায় অনায়াসে। এমনকি ১৪ দলীয় জোটের অনেক শরিক দলও এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
এক্ষেত্রে ১৪ দলীয় জোটের নির্বাচনী ইশতেহারের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। মাথা-ভারি প্রশাসনের হাত থেকে মুক্ত করে অভিজ্ঞ শ্রমিকদের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কিংবা সমবায়ের মাধ্যমে অভিজ্ঞ শ্রমিকদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে পাটকলগুলো চালু করা যেতে পারে, যেখানে ৫০ শতাংশ মালিকানা সরকারের থাকবে, ২৫ শতাংশ থাকবে অভিজ্ঞ শ্রমিকদের আর ২৫ শতাংশ থাকবে ব্যবসায়ীদের। সেইসঙ্গে এমন ব্যবস্থা নেয়া দরকার যাতে প্রতিটি কলের পরিচালনা পর্ষদেও শ্রমিক প্রতিনিধি থাকেন। প্রতিটি পাটকল যাতে স্বাধীনভাবে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে তেমন ব্যবস্থাও থাকা দরকার।
দীর্ঘদিনের সমস্যায় জর্জরিত এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পরিবর্তে সচল রাখার বিষয়ে মনোযোগী হওয়া জরুরি। লক্ষ করার বিষয় হল, বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম আঁশ থেকে তৈরি পণ্য ব্যবহারে আগ্রহ কমছে, কারণ এসব পণ্য ব্যবহারে নানা রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়। কৃত্রিম আঁশ পরিবেশবান্ধব নয়, পাট পরিবেশবান্ধব। বর্তমানে পাটের বহুমাত্রিক ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। পাটপণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। পাটের জেনম আবিষ্কার করেছেন একজন মেধাবী বাঙালি বিজ্ঞানী শামসুল আলম।
আমাদের পাট নিয়ে বহু ষড়যন্ত্র চলছে, এ বিষয়ে দেশি-বিদেশি চক্র সক্রিয়। বেশ কয়েক বছর আগে একটি আলোকচিত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকায় পাটের একটি আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেই প্রদর্শনীর কয়েকটি ভেন্যু ছিল, একটি ভেন্যু ছিল পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজারে; সেই অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন বিদেশি বক্তাও ছিলেন। সেখানে বাংলাদেশের একজন বক্তা বলেন, ব্রিটিশরা এ দেশে এসে পাট আবিষ্কার করেছে।
অথচ ইতিহাস হচ্ছে তাদের অনেকে এ দেশে এসে পাট সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। আমাদের কৃষককে নীলচাষে বাধ্য করেছে এবং অনেক অত্যাচার করেছে। আমাদের পাটের প্যাটার্নবন্ড রাইট দাবি করতে বহুভাবে ব্রিটিশরা আমাদের কিছু বুদ্ধিজীবীকে কৌশলে ব্যবহার করেছে এবং ষড়যন্ত্র করেছে।
আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে পাটবস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে মহর আলীর পাটের শাড়ি, হাজার বুটিক পাটের শাড়ি, সৈয়দ শামসুল হকের নুরুলদিনের সারাজীবনে আগুন পাটের শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ পাট বাংলার নিজস্ব সম্পদ, অত্যন্ত মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বহু তরুণ উদ্যোক্তা পাটবস্ত্র তৈরি করে বাজারজাত করছেন। শীতপ্রধান দেশগুলোতে পাটবস্ত্রের চাহিদা আছে।
পাটখড়ি থেকে বিজ্ঞানী কুদরত-ই খুদা পারটেক্স আবিষ্কার করেছেন। আমাদের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে আরও উন্নতজাতের পাট আবিষ্কার করা সম্ভব; এবং উৎপাদন আরও বাড়ানো সম্ভব। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে পাটশিল্পের হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তাই সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করা ঠিক হবে না।
বাংলাদেশের কৃতিসন্তান বিশ্বখ্যাত স্থপতি, স্থাপত্য শিল্পের দিকপাল, নলাকৃত স্থাপত্যের জনক এফ আর খান। তার এক সাক্ষাৎকার পাঠ করেছিলাম প্রায় ৩০ বছর আগে। সেখানে তিনি বলেছেন- তাকে একবার কোনো এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নলাকৃত স্থাপত্যের ধারণা তিনি কোথা থেকে পেলেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ছোটবেলায় সম্ভবত নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন তারা সপরিবারে।
সেসময় একদিন প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি হয়েছিল, গ্রামের অনেক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল; কিন্তু রান্নাঘরের পাশে যে কয়েক আঁটি পাটখড়ির ওপরের অংশ বাঁধা ছিল আর গোড়ার অংশ গোল করে ছড়ানো ছিল, ঝড়ে সেই পাটখড়ির আঁটিগুলোর কিছুই হয়নি; আগের মতোই দাঁড়িয়ে ছিল। সেই কিশোর বয়সে দেখা দৃশ্যটি পরবর্তী সময়ে নলাকৃত স্থাপত্যের সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল। বিশ্বখ্যাত এ স্থপতির কোনো সৃষ্টিকর্ম আমাদের দেশে নেই।
কয়েক বছর আগে জেনেছিলাম গুলশানের কোনো একটি বাড়ির নকশা ও স্থাপত্য তার সৃষ্টি, দুর্ভাগ্যবশত সেই বাড়িটি আমি খোঁজ করে পাইনি।
আফ্রিকা ও এশিয়ায় পাট চাষাবাদ হয়। পাটপাতা উল্লেখিত দেশগুলোতে ঔষধি খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে পাটপাতা দিয়ে তৈরি পলতা নামক এক ধরনের ঔষধি খাদ্য বহুল প্রচলিত। সেই রকম পাটপাতার শুকতানি এ অঞ্চলের মানুষের প্রিয় খাবার। মধ্যযুগে পাটের আঁশের ব্যবসা এমন পর্যায়ে বিস্তার লাভ করেছিল যে, নারায়ণগঞ্জে বলা হতো প্রাচ্যের ডান্ডি।
সুদূর স্কটল্যান্ডে ডান্ডিবন্দর ছিল বিশ্বের পাটপণ্য বাজারজাতকরণের মূল কেন্দ্র। সেখানে পাটের ব্যবসায়ীদের বলা হতো দ্যা জুট ব্যারেন্স। ইতিহাসবিদ আবুল ফজল রচিত আইনি আকবরীতে (১৫৪২-১৬০৫ সাল) পাট পণ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়।
চীনের হান রাজবংশের সময় ২০৬-২২০ খ্রিস্টপূর্ব পাট দ্বারা তৈরি বিভিন্ন পণ্যের ব্যবহারের উল্লেখ আছে। দেশের বন্ধ পাটকলগুলো চালু করতে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
ভাস্কর রাসা : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ভাস্কর্য শিল্পী