বাংলাদেশের কোথাও কোথাও বন্যা উপদ্রুত মানুষের পানিবন্দি দশা চলছে টানা ৪০ দিন। ইতিমধ্যে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তিন দফা বন্যা হয়ে গেছে। তারপরও এখনই এই দুর্যোগ কাটছে না বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। আগস্টের শেষ নাগাদ আরেকটি বন্যা হতে পারে আভাস দিয়েছেন তারা।
এজন্য আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যা মোকাবেলার প্রস্ততি নেওয়ার পরামর্শ এসেছে তাদের কাছ থেকে। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বন্যার জন্য মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণকেও দুষছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রও চলমান বন্যার ভেতরেই এই মাসের শেষের দিকে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল আকস্মিক বন্যায় আরেকবার ভাসতে পারে বলে আভাস দিয়েছে ।
সংস্থাটি বলছে, আগস্টের শেষের দিকে উজানে ভারি বর্ষণের পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলেও টানা বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে আকস্মিক বানে ডুবতে পারে ওই সব অঞ্চল। এটি হতে পারে খুবই স্বল্পমেয়াদি।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা ও মেঘনা অববাহিকায় নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনও দেশের ৮টি নদীর ১১টি পয়েন্টে পানি বয়ে যাচ্ছে বিপদসীমার উপর দিয়ে। আবার রাজধানী ঢাকার আশপাশের নদীর পানিও নামছে।
তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম তাতে খুব আশাবাদী হতে পারছেন না। তার ভাষ্য, বন্যার পানি যেটা স্বাভাবিকভাবেই চলে যেত, সে অবস্থাটা আমরা রাখিনি। পানি এখন কমছে। কিন্তু আরও এক দফা ভারি বৃষ্টি হতে পারে।
তিনি বলেন, ১৩ আগস্টের পরে আরেকবার ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। ফলে পানি এখনই পুরোপুরি নামবে না। আরও কিছু দিন বন্যার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের অবস্থা এখনই বলা না গেলেও আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, বৃষ্টি সামনে বাড়তে পারে। ফলে আরেকটি বন্যার জন্য তৈরি হয়ে থাকতে হবে।
অধ্যাপক সাইফুল বলেন, চলতি মৌসুমে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রস্তুত থাকতে হবে। যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহীর মত যেসব জায়গায় এবার বন্যা হয়নি, সেসব এলাকাতেও সামনে শঙ্কা থাকছে, কারণ গত বছর অক্টোবরের দিকে গঙ্গায় বন্যা এসেছিল।
এবার মৌসুমি বায়ু বেশি সক্রিয় থাকায় বর্ষায় ভারি বর্ষণ হয়েছে। তাছাড়া মানুষ নদীর গতিপ্রকৃতি বদলে দেওয়ায় আটকে থাকা পানি নামতে দেরি হচ্ছে। আর সে কারণেই মানুষকে দেড় মাস ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বলে বুয়েটের এ অধ্যাপকের ধারণা।
বুয়েটের ভূগোল ও পরিবেশের শিক্ষক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এবারের মৌসুমে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি, এবং হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। আর সাম্প্রতিককালে নদীগুলোতে তলানি জমছে বেশি। একইসঙ্গে নদীর প্রবাহ ক্ষমতা কমে গেছে। তাই বৃষ্টি বেশি হলেই প্লাবন হচ্ছে। কারণ সময়মত পানি নেমে যেতে পারছে না।
এ ভূগোলবিদ বলেন, বন্যার চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে নদী ভাঙন; দীর্ঘ সময় ধরে বন্যার কারণে দিনদিন ভাঙনের পরিমাণও বাড়ছে।
এরইমধ্যে ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, জামালপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার নিম্নাঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য এমনটাই বলছে।
বন্যা দুর্গত এসব জেলার ১৬৩টি উপজেলার এক হাজার ৭৩টি ইউনিয়নের ১০ লাখ ১৭ হাজার ৯১৪টি গ্রাম বন্যায় দুর্গত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৬০ হাজার ২৯১ জন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিকল্পনা) সাইফুল হোসেন বলেন, এ বছর বন্যার চরিত্রটা ভিন্ন রকম। ভাঙনটা বেশি হচ্ছে। আগে চাঁদপুর এলাকায় ভাঙন বেশি হত, এখন তা শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুরসহ অন্যান্য অনেক জায়গায় বেড়েছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ নিয়ে অভিজ্ঞতা তুলে ধরে এ কর্মকর্তা বলেন, দেশের মধ্যাঞ্চল একটা থালার মতো। বন্যার পানি নেমে যায় সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যে। কিন্তু পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে ভারী বর্ষণ, অমাবস্যা-পূর্ণিমার প্রভাব, সাগরে সতর্ক সংকেত থাকলে পানি নামার গতি কম থাকে।
সেই সঙ্গে নদীর প্রবাহে মানুষের হস্তক্ষেপ কিংবা প্রকৃতিকে স্বাভাবিকভাবে চলায় বাধা এলে তার দুর্ভোগও পোহাতে হয়।
রাজধানীর আশপাশে সমস্যা বিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ঢাকা শহরে এক সময় ৫২টি খাল ছিল। সিটি করপোরেশন, ওয়াসা, রাজউক বলছে, এখন ২২-২৩টা রয়েছে। অর্ধ শতাধিক খাল দিয়ে পানি যদি একসঙ্গে নেমে যেত তাহলে জমে থাকার কথা না।
নদী-নালা ভরে ফেললে বন্যার দুর্ভোগ বাড়বেই। শুধু বৃষ্টির জন্যই বাড়ে তা নয়, পানি বের করে দেওয়ার অবস্থা তৈরি করে দিতে হবে।
চলমান বন্যার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ঢাকার আশপাশে বন্যার পানি নামতে আরও এক সপ্তাহ লাগবে। সাভার, কেরানীগঞ্জ, দোহার, মানিকগঞ্জে পানি সহজে নামছে না। অন্য জায়গায় দ্রুত পানি নেমে গেলেও ঢাকায় সময় লাগবে বেশি।
কারণ, এসব এলাকায় প্রচুর রাস্তাঘাট হয়েছে, পানি বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়নি সেভাবে, ফলে পানি আটকে থাকছে। প্লাবনভূমিতে প্রচুর পানি ঢুকে গেছে, সেখান থেকে পানি সরতেও সময় লাগছে। এখন যদি ঘাসের প্লাবনভূমি থাকত, পানি নেমে যেত। কিন্তু তার বদলে বিভিন্ন পকেট তৈরি হয়েছে।
বন্যা ব্যবস্থাপনায় আমাদের অবস্থা ভালো না বলেই মত বুয়েটের এই শিক্ষকের। তিনি বলেন, ঢাকা ও এর আশপাশে যেসব জলাভূমি ছিল সব ভরে ফেলা হয়েছে। যেখানে পানি থাকলে স্বচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করা যেত, এখন সবখানে বাড়ি। সবই আরবান এরিয়া, ফ্যক্টরি- পানি যাবে কোথায়? পানি হয় নদীতে যাবে না হয় আশপাশে জমে থাকবে।… এটাই সমস্যা।
বাংলাদেশে আবহমানকাল ধরে বন্যা হচ্ছে। নিয়ম করে কমবেশি প্রতিবছরই হচ্ছে। তাহলে দিনদিন দীর্ঘায়িত বন্যার পেছনের কারণ কী? কোন বছর পরিস্থিতি কতটা খারাপ হবে তা দেশের ভেতরকার বর্ষাকালের প্রকৃতি এবং উজানে ভারতের পশ্চিমাংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।
সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুলের মতে, বন্যার কারণ আবহাওয়া ও জলবায়ুজনিত। তবে বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ার পেছনে বড় কারণ নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি, যেটা মানবসৃষ্ট। সবখানেই বাধা পাওয়ার কারণে সাগরে পানি নেমে যাওয়ার গতিটা কমে গেছে। এছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে আঞ্চলিকভাবে শহরের ভেতরে এখন বন্যাটা হচ্ছে।
অধ্যাপক সাইফুলও বলেন, বাংলাদেশে বন্যা হবে, পানি জমবে এটাই স্বাভাবিক। বন্যা অস্বাভাবিক রূপ নেয় তখনই, যখন বৃষ্টি বেশি হয়। আর পানি নামার পথে বাধা পেলে তা বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়।
এই পানি বিশেষজ্ঞের ভাষ্যে, এবার ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময়ের ভারি বৃষ্টিতে অনেক জলাভূমি ভরা ছিল। লঘুচাপও ছিল, যার ফলে মে মাসে বৃষ্টি ছিল বেশি। তাছাড়া মৌসুমি বায়ু এবার সক্রিয় ছিল বেশি। উজানের এলাকা নেপাল, আসাম, মেঘালয়, অরুণাচলে বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, উজানে এবার ১০ দিনে ২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিও হয়েছে কোনো স্টেশনে। এ ধরনের তীব্র বৃষ্টি হলে ভাটিতে বন্যা হবেই। জুলাই মাসে বাংলাদেশের পাশাপাশি আসাম, ভুটান, চীনে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। এ পানি তো বহ্মপুত্র অববাহিকা দিয়েই নামে।
আর পানি নামার এই পথে গত এক দশকে নগরায়ন বেশি হয়েছে। ফলে পানিটা নদী-নালায় সহজে যাচ্ছে না। আগে চারদিকে ডোবা ছিল, জলাধার ছিল। মাটি অনেক বেশি পানি টেনে নিতে পারত। এখন সেসবও কমে গেছে, যোগ করেন অধ্যাপক সাইফুল।
তিনি বলছিলেন, নদী তীরবর্তী প্লাবনভূমিও কমে গেছে। আগে যেসব জায়গায় পানি এসে জমা হয়ে থাকত। এখান সেখানেও আবাসন হচ্ছে। একইসঙ্গে নদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে প্রচুর; ব্রিজ, ড্যাম, ব্যারেজ তৈরি করা হয়েছে। তলদেশও অনেক জায়গায় ভরে গেছে। প্রবাহ না থাকায় নদী মরে যাচ্ছে। শীতকালে অনেক নদী পানিশূন্য হয়ে পড়ছে।
এছাড়া খাল হচ্ছে জলাধার। খালই যদি না থাকে, পানি নামবে কীভাবে? গত ১০-২০ বছরে সবখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। নগরায়ণ করতে গিয়ে প্লাবনভূমি দখল হয়েছে, বন উজাড় হচ্ছে যত্রতত্র। তাতে পানি ধরে রাখার পরিবর্তে ক্ষয় বাড়ছে। শিকড়সহ মাটি আলগা হয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় পাথর উত্তোলন বেড়েছে। ক্ষয়টা তরান্বিত হচ্ছে বলে মনে করেন এই বুয়েট অধ্যাপক।
বন্যার ধরন বদলানোর পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের ভূমিকা নিয়ে বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পবির্তনের প্রভাবকে আমরা স্টাডি হিসেবে দেখছি, ফাইনাল করতে পারিনি। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় এটি অনেক সক্রিয় হবে।
তিনি বলেন, বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা ও বৃষ্টি বেশি হবে। এখন আমরা যেটা দেখছি, সেটা আলামত হিসেবে ভাবা যায়। গত ৫ বছরে চারবার কিছুটা বড় আকারে বন্যা দেখলাম- ২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও এবার। এর আগে বন্যাগুলো এত ঘন ঘন হয়নি।
এ ধরনের দীর্ঘায়িত বন্যা থেকে বাঁচতে হলে বাঁচাতে হবে নদী। এ বিষয়ে নগর গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, পঞ্চাশের দশক থেকেই দেশে বন্যা ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনা রয়েছে, আশির দশকেও হয়েছে। এখন সরকার সুপার মেগা প্রজেক্ট বদ্বীপ পরিকল্পনা নিয়েছে।
তার ভাষ্য, বন্যা বাস্তব ঘটনা। নদীকে টিকিয়ে রাখা, জলাশয় বাঁচিয়ে রাখা, জলাধার ধরে রাখা- এসব থাকলে প্লাবনটা কম হয়। যেভাবে হোক, নদীর পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে হবে।
সেজন্য ব্যাপক ড্রেজিংয়ের সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, বড়-মাঝারি-ছোট নদীতে ড্রেজিং করার কথা আছে বদ্বীপ পরিকল্পনায়, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়নের দিকে যেতে হবে। বাস্তবায়নটা সঠিকভাবে করতে হবে।
এ পরিবেশবিদ আরও বলেন, নদী দখল হওয়া চলবে না। কোনো অবস্থায় ইজারাও দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
এই তিন বিশেষজ্ঞের একটা বিষয়ে একই ধরনের মতামত উল্লেখযোগ্য, সেটা হলো, নদী, খাল, জলাভূমি ভরাটসহ এসব স্থাপনায় মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপ দেশে দিনদিন বন্যাকে দীর্ঘায়িত করছে বলেই মনে হয়।