বর্তমানে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া, জাজিরা, ভেদরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়নের ৪০০ গ্রাম বন্যার পানিতে ডুবে আছে। তাতে আগে থেকেই বিপাকে থাকা মানুষের বিপদও বেড়েছে। জেলার সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় খাদ্য, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির চরম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে উপার্জনহীন মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। করনো, ভাঙ্গন, বন্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে এ জেলার মানুষের। এর ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগীরা। গরু-ছাগল নিয়ে বিপাকে পড়েছে কৃষক ।
শরীয়তপুরের বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বানভাসি মানুষের বেড়েছে দুর্ভোগ। জেলার বেশিরভাগই রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলি জমি। দ্বিতীয়বার পানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এ জেলার মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে । দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সংকট। সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত থাকলেও তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল গতকাল শুক্রবার পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে নড়িয়ার সুরেশ্বর পয়েন্টে। নড়িয়ার ঈশ্বরকাঠি, চোকদারকান্দি, মুলপারা, জাজিরার কলমিরচর, খালাসিকান্দি,পাইনপাড়া গ্রামে গিয়ে জানা গেল, প্রায় দেড় মাস ধরে ওই এলাকার মানুষ পানিবন্দী। করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষ আর আয়ের উপায় খুঁজে পায়নি। উপার্জন না থাকায় প্রায় সব পরিবারেই খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। এলাকার নলকূপ ও টয়লেট তলিয়ে যাওয়ায় খাওয়ার পানি এবং স্বাস্থ্যসংকট দেখা দিয়েছে। অনেকে নৌকায় বসবাস করছে, আবার অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে বসবাস করছে। জাজিরা উপজেলার পাইনপাড়া গ্রামের পিঞ্জিরা বেগম বলেন কৃষিজমি দুই বছর আগে পদ্মায় বিলীন হয়ে যায়। এরপর থেকে স্বামীর সাথে কৃষিশ্রমিকের কাজ করেন। পিঞ্জিরা গবাদিপশু লালনপালন করেন। তাদের আয়ে সংসার চলে। দেড় মাস ধরে বন্যার পানিতে এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় কাজ বন্ধ। তাদের ঘরে পানি উঠে যাওয়ায় গবাদিপশু নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। নিজেদের ও গবাদিপশুর খাদ্য সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পরিবারটিকে। পিঞ্জিরা বেগম বলেন, ‘কী অবস্থার মধ্যে আছি, তা বইল্লা বুঝাইতে পারুম না। স্বামীর কাম নাই, ইনকাম নাই। ঘরে খাওন নাই। দিনে একবার রান্না করি, বাচ্চারা দুইবার খায়। আর আমরা একবারই খাই। গরুর খাবারও নাই। জীবনে এত কষ্ট কহনো করি নাই।’ আমরা বেশিরভাগ সময় নৌকায় বসবাস করি, কোন সময় রান্না করতে পারি আবার কোন সময় রান্না না করেই, কোন রকম কিছু খেয়ে দিন কাটিয়ে দেই। জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, মধ্য জুন থেকে পদ্মা নদীতে পানি বাড়তে থাকে। তখন নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো তলিয়ে যায়। গত দেড় মাসে পানি বাড়তেই থাকে। বর্তমানে জেলার নড়িয়া, জাজিরা, ভেদরগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়নের ৪০০ গ্রাম বন্যার পানিতে ডুবে আছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৯৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে দুর্গত মানুষের জন্য। জেলা প্রশাসন ৬৪ হাজার ২০১ পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল এবং চার হাজার পরিবারকে শুকনা খাবার দেয়ার কথা জানিয়েছে। জাজিরার পাইনপাড়ার আরেক বাসিন্দা আঞ্জুমান বেগম বলেন, বসতবাড়ি, আবাদি জমি দুই বছর আগে পদ্মায় বিলীন হয়েছে। সব কিছু হারিয়ে আমরা এখানে এসে বসবাস করছি। করোনার কারনে আমাদের সব কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে এর পর আবার পানি হওয়াতে আমরা আরও বিপাকে পড়েছি, আমাদের কোন কাজ ক্রম নেই, ছোট্ট বাচ্চা কাচ্চা, গরু-বাছুর নিয়ে খুব সমস্যার মাঝে আছি। আমার স্বামীর পাঁচ মাস ধরে কোনো কাজ নেই। গরিব মানুষ কি কাজ না করে বাঁচতে পারে? এখন অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। নড়িয়ার মোক্তারেরচর ইউনিয়নের পাঁচ হাজার পরিবার পানিবন্দী। সরকারি ত্রাণ হিসেবে ৮০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল ও ৩০০ পরিবারকে শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। পানিবন্দীদের অধিকাংশই নদী ভাঙন কবলিত। অসহায় ও নিঃস্ব ওই সব মানুষের প্রত্যেকের খাদ্যসহায়তা প্রয়োজন জানিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলম চৌকিদার বলেন, ‘সরকারি যে ত্রাণ পাওয়া গেছে, তা খুবই অপ্রতুল। এলাকায় যেতে পারছি না, মানুষের কষ্ট দেখতে ভালো লাগছে না। এমনিতেই নদী ভাঙনে মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব। তার ওপর বন্যায় তাদের জীবন একে বারেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।’ স্থানীয় সাংসদ ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হকের উদ্যোগে কিছু ত্রাণসহায়তা দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ দেয়া চাল দুর্গতদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। প্রত্যেককে এক দফা করে দেয়া হয়েছে। ইউএনওদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে দ্বিতীয় দফার চাহিদা দেয়ার জন্য। পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হলে মানুষের দুর্ভোগের কথা বিবেচনা করে দ্বিতীয় দফা খাদ্যসহায়তা দেয়ারও প্রস্তুতি রয়েছে।