স্ট্রোক, মস্তিষ্কে আঘাত, মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার বা অন্য কোনো কারণে যদি আমাদের ব্রেন স্টেমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাকে বলা হবে ব্রেন ডেথ। ব্রেন স্টেম হলো মস্তিষ্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য। মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর (হৃদযন্ত্র, ফুসফুসসহ অন্যান্য) নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হলো ব্রেন স্টেম। ব্রেন স্টেম অকার্যকর হয়ে গেলেও আমাদের হৃদযন্ত্রের মাংসপেশির বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে লাইফ সাপোর্ট যন্ত্রের সাহায্যে আরও কিছুদিন সেই মানুষটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। যদিও তার বাকি অঙ্গগুলো অকার্যকর হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। একমাত্র নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) বিশেষ মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর (লাইফ সাপোর্ট) যন্ত্রের মাধ্যমে রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস পরিচালনা করা হয় এবং অন্য অঙ্গগুলো সচল রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, ব্রেন ডেথ নিশ্চিত হয়ে গেলে সেই মানুষটি আর ফিরে আসবে না।
ক্যাডাভেরিক হলো যাদের আইসিইউ’তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মস্তিষ্ক অচল হয়ে যায় এবং যাদের বাঁচার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় তাদেরকে ক্যাডাভেরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যদি তারা ক্যান্সার হেপাটাইটিস, এইচআইভিসহ অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত না হয় তারা ক্যাডাভেরিক হিসেবে অঙ্গদান করতে পারে। মরণোত্তর অঙ্গদান আর ক্যাডাভেরিক অঙ্গদান এক বিষয় নয়। মানুষ মারা যাবার পর শুধুমাত্র তার কর্নিয়া ( যা ৬ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করে) প্রতিস্থাপন করার মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আইসিইউ’তে ব্রেন ডেথ রোগীর হার্টসহ অন্যান্য অঙ্গ সচল থাকে। ব্রেন ডেথ রোগীর ব্রেন ছাড়া সব সচল থাকে। এমন রোগী থেকে আটটি অঙ্গ নিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অন্য মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। আর ব্রেন ডেথ রোগী শুধু আইসিইউতেই পাওয়া যায়। কোনো ব্যক্তি ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত হওয়ার পর কিডনি, হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, যকৃৎ বা লিভার, অগ্ন্যাশয় (প্যানক্রিয়াস) ও খাদ্যনালির মতো অঙ্গগুলো দান করলে অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। তবে হৃৎপিন্ড থেমে গেলেও কর্নিয়া, অস্থি, অস্থিমজ্জা ও চর্ম প্রতিস্থাপন করা যায়। এগুলোকে ক্যাডাভেরিক প্রতিস্থাপন বলা হয়।
একজন ব্রেন ডেথ মানুষের দেওয়া অঙ্গগুলোর মাধ্যমে মোট আটজন মানুষের জীবন রক্ষা করা সম্ভব। দুটি কিডনি, দুটি ফুসফুস, একটি হৃদ্যন্ত্র, একটি অগ্ন্যাশয়, পূর্ণাঙ্গ অন্ত্রনালি এবং যকৃৎ। উন্নত দেশগুলোয় অনেক আগে থেকে ব্রেন ডেথ রোগীর শরীর থেকে অঙ্গগুলো সংগ্রহ করে অন্যের জীবন রক্ষা করার কাজ প্রচলিত আছে।
মৃত্যু এক অবধারিত সত্য। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এই মৃত্যুর ধরনে রয়েছে নানা মত। ঐতিহাসিকভাবে একজন মানুষকে তখনই শুধু মৃত বলা হতো, যখন তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স¤পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তবে ৫০-৬০ বছর ধরে মৃত্যুর আরেকটি রূপ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেটি হলো ব্রেন ডেথ বা ব্রেন স্টেম ডেথ। এ ধারণাটি ব্যবহৃত হয় ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে। আবার যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের মৃত্যুকে বলা হয় হোল ব্রেন ডেথ সংযোজন করা হয়েছে বিগত কয়েক দশকে।
১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আইনের মাধ্যমে দুই ধরনের মৃত্যুকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। একটি হলো সারকুলেটরি ডেথ (হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধজনিত মৃত্যু)। অন্যটি হোল ব্রেন ডেথ (মস্তিষ্কের পুরো কর্মকান্ড বন্ধ কিন্তু হৃদ্যন্ত্র সচল থাকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত)। সারকুলেটরি ডেথ ইংল্যান্ডেও প্রচলিত। তবে হোল ব্রেন ডেথ ইংল্যান্ডে ব্রেন ডেথ বা ব্রেন স্টেম ডেথ নামে সংজ্ঞায়িত।
আমাদের দেশের আইসিইউতেও অনেক সময় ব্রেন ডেথ রোগী ভর্তি হয়ে থাকেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাঁদের সময়মতো ব্রেন ডেথ ঘোষণা করা যায় না। একটি কারণ হলো এ ধরনের মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব। তাঁরা এই রোগীকে মৃত বলে মেনে নিতে চান না। কারণ, তখনো রোগীর হৃদযন্ত্র সচল থাকে। আবার কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরাও অনাহূত বিপদের আশঙ্কায় ব্রেন ডেথ ঘোষণা এড়িয়ে যেতে চান। অনেক হাসপাতালে হয়তো ব্রেন ডেথ ঘোষণাদানকারী কমিটি থাকে না। একজন সারাহ ইসলামের মাধ্যমে আলোকিত হয়ে উঠেছে ব্রেন ডেথের ধারণা। সারাহ ইসলাম ২০ বছরের এক তরুণী। তাঁর যা শবনম সুলতানা একজন শিক্ষক। জন্মের মাত্র ১০ মাস পরেই ধরা পড়ে যে সারাহ ইসলাম টিউবেরাস স্কে¬রোসিস রোগে আক্রান্ত। মৃত্যুর আশঙ্কা অনেক বেশি, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই। তখন থেকে সারাহ ও তার পরিবারের যুদ্ধ শুরু হয় এই রোগটির বিরুদ্ধে। দীর্ঘ প্রায় ১৯ বছর সারাহ এই রোগটির সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন।
সারাহ ইসলাম মেধাবী একজন ছাত্রী ছিলেন। জটিল এই রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করেও তিনি সাফল্যের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে চারুকলায় স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি সুদক্ষ চিত্রশল্পী ছিলেন। মানবতাবাদী ছিলেন। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। তাই তাঁর মা শবনম সুলতানা তাঁর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে এই অঙ্গদানে সম্মতি দিয়েছেন। সম্মতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করা হয় সঠিক অঙ্গগ্রহীতার খোঁজ। প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে ছয়জন সম্ভাব্য রোগীকে পরীক্ষা করে সেখান থেকে দুজনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়। গত ১৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টা থেকে জটিল এই অস্ত্রোপচার শুরু হয় এবং শেষ হয় পরদিন ভোর প্রায় পাঁচটার দিকে। আইন অনুযায়ী গঠিত প্রতিটি টিম এখানে সুদক্ষভাবে কাজ করেছে। প্রতিস্থাপন দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন ইউরোলজিস্ট ও ট্রান্সপ্লান্ট সার্জন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান। ইউরোলজিস্ট, নেফ্রোলজিস্ট, আইসিইউবিশেষজ্ঞ, কিডনি ফাউন্ডেশন, সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান কমিটির সবাই সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে এই কাজে যুক্ত ছিলেন।
আমি ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মৃত ব্যক্তির দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নেই। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন লজিস্টিক সহায়তাসহ প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রিফ কাউন্সিলর (শোকার্ত মানুষকে মানসিক সহায়তাদানকারী) গঠন, অন্য হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি ইত্যাদি কাজ শুরু করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ে দীর্ঘ প্রস্তুতির পর গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো মরণোত্তর দান করা কিডনি প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেই। জরুরি ভিত্তিতে কিডনি প্রয়োজন এমন ৫০ রোগীর তালিকা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়। এর মধ্যে অন্তত তিনবার মৃত ব্যক্তির কিডনি পাওয়ার আগমুহূর্তে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়দের অনীহায় প্রতিস্থাপন করা যায়নি। মরণোত্তর দানের কিডনি প্রতিস্থাপনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় । এ জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের আইসিইউর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় চুক্তি করেছে। সেখানে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত আইসিইউর রোগীদের পরিবার সম্মতি দিলে কিডনি নেওয়া হবে । ছয় মাস ধরে বেশ কয়েকবার এমন কিডনি পাওয়ার ব্যবস্থা হলেও তা সংগ্রহ করা যায়নি। এক রোগী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় আইসিইউতে। ওই রোগীর পরিবার কিডনি দান করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু আইসিইউ থেকে ওই রোগীর টিউব খুলে ফেলা হয়। এ কারণে আইসিইউ ব্যবস্থাপনায় থাকা ব্যক্তিদের ভুলে শেষ মুহূর্তে সংগ্রহ করা যায়নি। একই ঘটনা ঘটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আরেক রোগীর ক্ষেত্রে। আগে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে এক রোগী ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষিত হলে পরিবার কিডনি দিতে সম্মত হয়। তবে ভোরবেলা রোগীর মৃত্যু হলে পরিবারটি মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যায়। হাসপাতাল থেকেও দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
ইসলাম ধর্মে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে কোন বাধা নেই। ১৯৯৫ সালে মুসলিম শরীয়া কাউন্সিল অঙ্গ প্রতিস্থাপন বৈধ বলে ফতোয়া দিয়েছে। পবিত্র কোরআনুল কারীমে বলা আছে, যদি কোন মানুষ অন্য কোন মানুষের জীবন রক্ষা করে, তাহলে সে যেন সমগ্র জাতির জীবন রক্ষা করলো। মদিনা ইনস্টিটিউট এর শিক্ষক শায়খ আব্দুল আজিজ আহমেদ বলেন, I am proud to have been on the donor register for many years. I am more convinced than ever of the importance of the organ donation and the great benefits it brings.
হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের স্কলারদের মতেও অঙ্গ প্রতিস্থাপন ধর্মীয় মতে গ্রহণযোগ্য এবং মানুষের জন্য একজন মানুষের সর্বোচ্চ উপহার স্বরূপ, যা মানব জাতিকে নতুন ওই আলোকিত করবে।
মরণোত্তর অঙ্গদানে সচেতনতা বাড়াতে কিছু করণীয় অত্যাবশ্যকঃ
সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে তাদের সভা-সমাবেশে এর প্রয়োজনীয়তা বলতে হবে।
সমাজের বিশিষ্টজনদের তাদের কর্মকান্ডের মাধ্যমে মানুষকে বোঝাতে হবে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে এর প্রয়োজনীয়তা বলতে হবে।
বেশি বেশি করে ক্যাডাভেরিক সভা-সেমিনার করতে হবে।
ধর্মগুরুদের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মীয় সভায় বলতে হবে।
সমস্ত যোগাযোগ মাধ্যম যেমন, সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার করতে করতে হবে।
বিভিন্ন ডকুমেন্টরি-নাটিকা তৈরি করে মানুষকে বোঝাতে হবে।
ডোনার কার্ড করতে হবে। যেমনঃ কোন পরিবারের কেউ অঙ্গ প্রদান করলে, কখনো তাদের প্রয়োজন হলে তাদেরকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সারাহ ইসলামই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ব্রেন ডেথ থেকে মৃত্যুর আগে নিজের অঙ্গ দান করে চারজন মানুষের জীবনে আশা জাগিয়ে গেলেন। সারাহ ইসলামের দিয়ে যাওয়া উপহার সবচেয়ে দামি উপহার। জীবনদায়ী উপহার। একজন মানুষ কতটুকু মহান হলে এই কাজ করতে পারেন! সারাহ দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে মৃত্যুকে পরাজিত করা যায়। মৃত্যুর পরও সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকা যায়। মৃত্যুর পরও কীভাবে অন্য মানুষের উপকার করা যায়। আমার কাছে সারাহ ইসলাম হলো মানবতার প্রকৃত ফেরিওয়ালা। নশ্বর দেহের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অপর এক প্রাণের নাম হলো সারাহ ইসলাম। বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের জগতে এই নাম চিরদিন খোদাই হয়ে থাকবে। মানবতার জগতে তিনি আমাদের কাছে এক অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবেন। আমার দায়িত্ব গ্রহণের পর, দেশ স্বাধীনের ৫২ বছরের মধ্যে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের ২৫ বছরের ইতিহাসে এ ধরণের অঙ্গ সংযোজন করতে পারায় সৃষ্টিকর্তার নিকট আমি কৃতজ্ঞ।
লেখক: উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়।