আজ ১৮ অক্টোবর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্টপুত্র শেখ রাসেলের শুভ জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের এমন এক হেমন্তের মৃদু শিশিরস্নাত রাতে শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। হেমন্তে তার জন্ম হলেও ঝরা পালকের মতো অন্তর্ধান ছিল তার নিয়তি। রাসেলের যেদিন জন্ম হয় বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারণায় অংশগ্রহনের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন।
স্বল্পায়ু জীবনে বাবার সংঙ্গে একরাশ স্মৃতি জমা করার সুযোগ না পেলেও বাবাকে নিয়ে শেখ রাসেলের স্মৃতি ভান্ডার কিছু কম সমৃদ্ধ নয়। জীবনের একটি বিশাল সময় বঙ্গবন্ধু জেলে কাটিয়েছেন। অন্য সন্তানেরা বিষয়টির গাম্ভীর্য বুঝলেও কনিষ্ট পুত্র শেখ রাসেল বিষয়টি বুঝতে পারত না। তাই শিশু রাসেল বাবাকে জেলে দেখতে আসলে তাঁকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইতো।
ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সেই বিখ্যাত বাড়ির একপাশে বঙ্গবন্ধুর পড়ার ঘর। সেই ঘরে বসে বঙ্গবন্ধু লেখালেখি করতেন। কিন্তু রাসেলের মনে প্রশ্ন জাগে, কি লেখেন বাবা? তাই মাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘মা’ বাবা টেবিলে ঝুঁকে পরে কি লেখে?
ছেলের কথা শুনে মা হাসেন। তারপর শেখ হাসিনাকে ডেকে বলেন, ‘‘ হাসু শুনে যা তোর ছোট ভাই কি বলে। শুনে যা” শেখ হাসিনা রাসেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘রাসেল, তুই নিজে বাবাকে জিজ্ঞেস কর, বাবা তো বাড়িতে তোকেই সবচেয়ে বেশি আদর করে’।
বাবার সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ খুব বেশি না পেলেও বাবার খুব প্রিয় ছিল রাসেল। বাবাও ভালোবাসতেন ছোট রাসেলকে। কর্মব্যস্ত দিনপঞ্জির মধ্যে সময় পার করলেও রাসেলকে আদর করতে ভুলতেন না তিনি। প্রতিদিন সকালেই ঘুম থেকে জেগে গিয়ে একটু সময় বাঁচিয়ে পরম ভালোবাসায় তার ছোট ফুটফুটে রাসেল সোনার কপালে, মাথায়, বুকে, চিবুকে, গালে, চুলে আদর করে দিতেন বঙ্গবন্ধু। ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার বিষয়ে শেখ হাসিনা লিখেছেন, আব্বার সঙ্গে প্রতি ১৫ দিন পর আমরা দেখা করতে যেতাম। রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুবই কান্নাকাটি করত। ওকে বোঝানো হয়েছিল যে, আব্বার বাসা জেলখানা আর আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা বাসায় ফেরত যাব। বেশ কষ্ট করেই ওকে বাসায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর আব্বার মনের অবস্থা কী হতো তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায় আসার জন্য কান্নাকাটি করলে মা ওকে বোঝাতেন এবং মাকে আব্বা বলে ডাকতে শেখাতেন, মাকেই আব্বা বলে ডাকতে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন তিনি। পৃথিবীতে যুগে যুগে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ঘটেছে কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকান্ড কোথাও ঘটেনি। রাসেলের মৃত্যুর দিনটিও পিতার আশীর্বাদেই উজ্জল হওয়ার কথা ছিল। সমাবর্তন উপলক্ষে পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট জানানোর জন্য ইউল্যাব স্কুলের পক্ষ থেকে বাছাই করা হয়েছিল ছয়জন শিক্ষার্থীকে। বঙ্গবন্ধু পুত্র রাসেল ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। কিন্তু জাতির পিতাকে আর স্যালুট জানানো হয়নি শেখ রাসেলের। ঘাতকের বুলেট তার আগেই কেড়ে নিয়েছে ছোট রাসেলের প্রাণ। মাত্র ১১ বছর বয়সে তাকে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যদের সংঙ্গে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
শেখ রাসেল যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে আজ তার বয়স হতো ৫৯ বছর। এই বয়সে তিনি নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে সামিল হতেন। ভিশন ২০৩০, ২০৪১, ডেল্টা প্ল্যান, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে তার বোন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে থেকে আধুনিক উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মানে কাজ করতেন।
হয়তো তিনি বিজ্ঞানী অথবা জাতির পিতার মতো বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার কান্ডারী হতেন। কিংবা হতে পারতেন রার্ট্রান্ড রাসেলের মতোই স্বমহিমায় উজ্জ্বল বিশ্বমানবতার প্রতীক।
রাসেল মারা যাওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হারিয়েছেন তার আদরের ছোট ভাইকে আর বাংলাদেশ হারিয়েছে একজন সম্ভাবনাময় প্রতিভাবান সন্তানকে। শেখ রাসেল আজ প্রতিটি শিশু কিশোর তরুনের কাছে ভালোবাসার নাম, মানবিক বেদনাবোধ সম্পন্ন মানুষেরা শহীদ শেখ রাসেলের বেদনার কথা হৃদয়ে ধারন করে চিরদিন শিশুদের জন্য কাজ করে যাবে। ইতিহাসের মহা শিশু হয়েই বেঁচে থাকবে প্রতিটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে।
——–
উপাচার্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
শাহবাগ, ঢাকা।