ভয়াবহ খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে দেশ। অংকটি এখন ভয়নাক পর্যায়ে, ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা গত সাড়ে ১১ বছরে সর্বোচ্চ। এজন্য দায়ী করা হয়েছে মুরগি ও ডিমকে। পরিকল্পনামন্ত্রীর ভাষায়, আগস্টে মূল্যস্ফীতির মূল নায়ক মুরগি ও ডিম। তার মতে, ‘উদীয়মান অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি এক ধরনের আশীর্বাদ’। ‘যে সাপের খেলা জানে, সে ঠিকই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। অর্থমন্ত্রী দেশের অথর্নৈতিক অবস্থা খারাপ বললে ক্ষেপে যান। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, যারা বলে দেশের অবস্থা খারাপ, তারা অর্থনীতি বোঝেন না। অর্থনীতি সম্পর্কে তাদের কোনো পড়াশোনা নেই। অবশ্য বাণিজ্যমন্ত্রী ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ‘কিছুটা’ বেড়েছে স্বীকার করেছেন। তবে, দায় চাপিয়েছেন ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে যাওয়া ও পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়াসহ কয়েকটি কারণের ওপর।
মূল্যস্ফীতি দিয়ে আমরা যেটা বুঝি তা হলো, কোনো একটা নির্দিষ্ট সময় থেকে পরবর্তী আরেকটি সময়ে দাম কেমন বেড়েছে? যেমন একটা জিনিসের দাম ২০২২ সালে ছিল ৫ টাকা, পরবর্তী বছর তা হয়েছে ৬ টাকা। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি জানা গেলে বোঝা যায়, কোনো নির্দিষ্ট সেবা বা পণ্যের জন্য আগের তুলনায় একজন মানুষকে কত টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে এবং তা তার জীবনযাত্রার ওপর কতটা প্রভাব ফেলছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশ বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। কিন্তু, বলার সময় আরেকটু বেশি করে বলার চর্চা বাংলাদেশে রয়েছে। কৃষি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিপ্লব এনেছে বলে প্রচারটা একটু বেশি। পাট উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, চাল উৎপাদনে তৃতীয়, বিভিন্ন সুগন্ধি মসলা এবং কয়েক ধরনের ফল উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, ডাল, কাঁঠাল, লিচু এ ধরনের শস্য ও ফল উৎপাদনে ষষ্ঠ অবস্থানে বাংলাদেশ। আলু, পেঁয়াজ, আদা, চা, মিষ্টিকুমড়া, সিডস, ব্রকলি, আম-এসব শস্য ও ফল উৎপাদনে তার অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ দশটি রাষ্ট্রের মধ্যে। প্রায় বিশটি পণ্যে পৃথিবীতে দশম স্থানের মধ্যে আছে। অর্থাৎ বিভিন্ন কৃষিপণ্যে এক থেকে দশের মধ্যে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যানের এসব তথ্যের সঙ্গে বাজারের চিত্র মিলছে না। গোল আলু থেকে শুরু করে কচুর লতি-শুঁটকিসহ কোনো পণ্যই সাধারণ ক্রেতাদের আয়ত্বে নেই। বাজার ব্যবস্থাপনায় চরম নৈরাজ্য। সরকারি ঘরানার ব্যবসায়ীদের ফ্রিস্টাইলের কাছে বাজার জিম্মি। বিশ্ববাজারে কমলেও তাদের কা-কীর্তিতে বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের দাম কেবলই বাড়ছে। তাও রেকর্ড মাত্রায়। সরকারের দিক থেকে সবসময় তা মানতে অনীহা। তারওপর সারের দামও চড়া। ক্রমেই তা প্রকট হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় গ্যাস সংকটে কয়েকটি সার কারখানায় উৎপাদন স্থগিত।
প্রকৃতির বিরূপ আচরণের কারণে এমনিতেই বিপাকে রয়েছে কৃষক। চলতি বছর দুই দফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আউশ আবাদ। নষ্ট হয়ে গেছে রোপা আমনের বীজতলাও। এদিকে ভরা বর্ষা মৌসুমেও কোনো কোনো অঞ্চলে নেই পর্যাপ্ত বৃষ্টি। অনাবৃষ্টিতে সৃষ্ট খরার কারণে পিছিয়ে গেছে রোপা আমনের চাষ। এমন অবস্থায় কৃষক সেচ দিয়ে আমন ক্ষেত প্রস্তুত করছে। সেখানে আবার বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে ডিজেল। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে কৃষি উপকরণ, বীজ ও বালাইনাশক। শ্রমিকের বাড়তি মজুরি তো রয়েছেই। এসব ফসলের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিস্থিতিটি চালসহ কৃষিপণ্যের দাম আরো বাড়ার নমুনা। কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার শঙ্কাও আছে। ভূরাজনীতির সঙ্গে বৈশ্বিক খাদ্যবাজার জড়িয়ে পড়াটা বিপজ্জনক।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের আগ থেকেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, সারা বিশ্ব খাদ্যসংকটে পড়তে যাচ্ছে। সেই সতকর্তা ফলতে শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশ আগাম ব্যবস্থা নিয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশই দ্রব্যমূল্য লাগামে আনতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের পাশের দেশ শ্রীলঙ্কাও পেরেছে। তাদের মূল্যস্ফীতি ছিল ৪৯ শতাংশ। দেশটিই দেউলিয়া হয়ে যায় প্রায়। সেখানে সরকারেরও পতন হয়ে যায়। অথচ, সেই শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের মূল্যস্ফীতি এখন ৫ শতাংশ। শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়ালো কীভাবে, তা আমাদের আমলে নেয়ার গরজ কম। বৈশ্বিক সংকটকে দায়ী করতে পারলেই যেন দায়বদ্ধতা শেষ, সুষ্ঠু সমাধানের নেই কোনো ব্যবস্থা। ফলে এ সুযোগটা নিচ্ছে একটি দুষ্টচক্র বা তথাকথিত সিন্ডিকেট। তাদের উড়ানো ধুলায় চোখে যেন অন্ধকার, এদিকে মুখে বোবা কান্না নি¤œ ও মধ্যবিত্তের। আজ ডিম তো কাল লবণ-মরিচ-পেঁয়াজ-আদা, চাল-ডাল-তেল, কিছুতেই যেন ছাড় নেই। ধনাঢ্যদের কথা আলাদা। চালের কেজি পাঁচ শ’, পেঁয়াজ হাজার বা কাঁচা মরিচের কেজি দু’হাজার টাকা হলেও কোনো ঝাঁঝে পাবে না তাদের। উপরন্তু, ‘সারাবিশ্বেই পণ্যমূল্য বাড়তি, বাংলাদেশে সেই তুলনায় কম’Ñ ধরনের কথা ছুঁড়ে দিতে তাদের বিবেকে একট্ওু বাঁধবে না। চালের বিকল্প আলু-কাঁঠাল বা বেগুনের বিকল্প কুমড়া-পেঁপে বাতলে দেয়ার মশকরায়ও লজ্জিত হবেন না। লজ্জায় প্রিজারভেটিভ দেয়া সম্প্রদায়ের ‘ভাত না খেলে কী হয়, বলতে মুখে আটকাবে না।
প্রকারান্তরে এদের ঘায়েলের আঘাত সর্বোচ্চও। চাল, ডাল, তেল, নুন, চিনি, আটা, ময়দা, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, চামড়া, আমড়া সব কিছু নিয়েই খেলছে সমানে। ডিমের বাজারও দফায়-দফায় তাদের হাটটিমা-টিম গেইমের শিকার মানুষ। ডিম যে কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে সেই তালগোল পর্যন্ত বাঁধিয়ে দেয়ার পারঙ্গমতা দেখিয়েছে চক্রবাজরা। সুঁই-সুতা থেকে ওষুধ-পথ্যও তাদের গেম ফিল্ড। দু’হাতে অর্থ হাতানোর এ পদ্ধতিতে চাহিদা, জোগানের পরিমাণ; কে সরবরাহকারী-বিপণনকারী, কে ভোক্তা; এসবের কোনো বালাই নেই। শিকার ধরাই আসল কাজ। বাজার নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের কাছে বাদবাকিরা কেবলই শিকারের বস্তু। বাজার চড়ানোর পেছনে শীত-গরম, বৃষ্টি-খরা, মন্দা-যুদ্ধসহ হরেক অজুহাত তারা হাতে হাতেই রাখে। সরকারকে বানিয়ে ফেলে তাদের সেই অজুহাত প্রচারকারী জনসংযোগ কর্তৃপক্ষ। মন্ত্রীকে পর্যন্ত বলতে হয়, সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। খোদ মন্ত্রী বলে দেন, নাম বললে তার জীবন চলে যাওয়ার শঙ্কা আছে। খেলাটা কী আচানক! সিন্ডিকেটের প্রবল ক্ষমতার কাছে সরকারেরই যখন অসহায়ত্ব, তখন সাধারণ মানুষের জায়গা কোথায়?
বাজারে চাহিদার বিপরীতে জোগান কমে যাচ্ছে নাকি কমিয়ে দেওয়া হচ্ছেÑ তাও একটা প্রশ্ন। ব্যবসায়ী নেতারাই বলছেন, সব পণ্য দ্রব্যই মজুত আছে, নাটক চলছে কৃত্রিম সংকটের। যে কৃত্রিমতা কম-বেশি অন্যান্য সেক্টরেও। চতুর্মুখী এ অস্বাভাবিকতায় কৃষক উৎপাদন করে, মাঠে ফসল দেখে হাসে, আর বিক্রি করে কাঁদে। বাজারে মৌসুমেও চালের দাম কমে না, সবজির দাম তেমন কমে না। কিন্তু কৃষকের ভাগ্যে যে ন্যায্য দাম জোটে না- সেই বেদনা কেবল কৃষকরাই ভোগে, হজম করে। কৃষি বাজেট বাড়ে না কেন, কৃষি উপকরণের মূল্য সহায়তা কৃষক কতটুকু পান, কৃষি উৎপাদন করে কেন কৃষক অসহায় ফড়িয়াদের কাছে? এসব প্রশ্ন অসহ্য-বিরক্তিকর ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ের কাছে। দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান কৃষিতে। খাদ্য চাহিদার ৯০ শতাংশ পূরণ করে কৃষি খাত।
সাধারণ মানুষের খাদ্যপণ্য চাল, আটা, ডাল, চিনি, তেল, লবণ, সবজি, পেঁয়াজ, মরিচ, মাছ, ডিম, মুরগি কোনটার দাম না বেড়েছে? সব কিছুর দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এটি সিন্ডিকেটের দারুণ সমন্বয় ও সুযোগ। মলম পার্টির মতো জোরজবরদস্তি লাগছে না। মানুষকে আপোসেই নিজের চোখে নিজে মলম মেখে বোবা কান্না কাঁদতে হচ্ছে। একবার পেঁয়াজ, আর একবার মরিচ, কখনো ডিম তো কখনো মুরগি! এক মাসে তেলে আর ডালে চক্রাকারে চক্রশুলে চড়ছে। মৌসুমে পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকা ছুঁয়ে ফেলল তারপর আবার ৬০ টাকায় নেমে এলো। এ সময়কালে পেঁয়াজের কোনো নতুন উৎপাদন কি হয়েছে? তাহলে দাম কমল কেন? মূলত এ সময়ে উৎপাদন হয়েছে ব্যবসায়ীর মুনাফার আর জনগণের দুর্দশার। নিদারুণ বাস্তবতায় রাজনীতিতে এগুলো ইস্যু হয় না। মিছিল, পদযাত্রা, শোভাযাত্রার বিষয়আসয় সব রাজকীয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট