মানুষ জন্ম নেওয়ার পর থেকে ক্রমেই বেড়ে ওঠে। সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সুখ-দুঃখের নানা পথ পাড়ি দিয়ে কিশোর ও যৌবন পাড়ি দিয়ে জীবনের ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছে। একসময় শরীরে বার্ধক্য আসে। কমে আসে কর্মক্ষমতা। সুস্থ স্বাভাবিক প্রতিটি মানুষের জীবনেই এই চক্র আবর্তিত হয়। আজ আমাদের মা-বাবা প্রবীণ ব্যক্তি। আগামীকাল আমার জন্যও এই সময়টা অপেক্ষা করছে। বার্ধক্য প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। মানুষের জীবনে বার্ধক্যের বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। কিন্তু এই স্বাভাবিক নিয়ম কখনো কখনো মানুষের জীবনে বয়ে আনে অনেক দুঃখ, কষ্ট। সময় ও শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি প্রবীণদের মানসিক পরিবর্তণ স্বাভাবিক। এসময় তাদের একাকিত্ব বেড়ে যায়। তাই এ সময়ে তাদের আশেপাশের মানুষের উচিৎ পাশে থাকা, সাহায্যের হাত বাড়ানো। কিন্তু বর্তমানে বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ প্রবীণ ব্যক্তিরাই অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত এবং বৈষম্যের শিকার। জাতিসংঘ বার্ধক্যকে মানবজীবনের প্রধানতম চ্যালেজ্ঞ হিসেবে উল্লেখ করে এ সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করে আসছে।
প্রতিবছর জাতিসংঘ থেকে প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এবছর প্রবীণ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো “Fulfilling the promises of the universal declaration of human rights for older persons: across generations” “সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় প্রবীনদের জন্য প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি পূরণে প্রজন্মের ভূমিকা।”
স্বাভাবিকভাবে ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষকে আমাদের দেশে প্রবীণ বলা হয়। বাংলাদেশে সরকারি চাকুরি থেকে অবসরের বয়স ৫৯ বছর। তবে বিচারপতিদের জন্য ৬৭ বছর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অন্য কোন পেশাজীবিদের জন্য ৬৫ বছর। কারণ এ বয়সের পর মানুষের দৈনন্দিন জীবিকা উপার্জনের কাজ থেকে অবসর নেয়। বিশ্বে উন্নত দেশগুলোতেও ৬০ বা ৬৫ বয়সের পর একজন মানুষকে প্রবীণ বা ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২২ শতাংশ প্রবীণ হবে। ২০৪৪ সালে যা কমবয়সী জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমানে বাস করছে প্রায় ১ কোটি ৪৫ লাখ প্রবীণ। ২০২৫ সালে এর সংখ্যা হবে প্রায় ২ কোটি ৮০লাখ, ২০৫০ সালে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০৬১ সাল নাগাদ হবে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা-প্রযুক্তি, জীবন-সচেতনতা এবং যাতাযাত-যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ুস্কাল অনেক বেড়েছে এবং বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশে সরকারী পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রবীণ সেবার পরিধি অত্যান্ত সীমিত, বেসরকারী প্রবীন নিবাসগুলোর অধিকাংশের অবস্থা শোচনীয় । বৈশ্বিক মহামারী দেশের প্রবীন জনগোষ্ঠীকে অত্যান্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রবীনদের জন্য প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য সেবা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারীর সময় তাদের যথাযথ সুরক্ষা এবং সহায়তা প্রদান করা রাষ্ট্রীয় কর্তব্য।
বাংলাদেশের অনেক প্রবীণ নিজেদের সন্তান-সন্তত্তি কর্তৃক প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। পিতামাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে জোর করে বৃদ্ধাশ্রমে বা অন্য কোথাও পাঠানো যাবে না মর্মে আইনের বিধানটিও লংঘিত হচ্ছে। জীবিকা নির্বাহের জন্য এখনো অনেক প্রবীণকে কোন না কোন ধরনের কায়িক প্ররিশ্রম করতে হয় এবং অনেক প্রবীণকে ক্ষূধার্ত অবস্থায় নিদ্রায় যেতে হয়। তাঁদের প্রায় অর্ধেকেরই কোন না কোন প্রকারের পারিবারিক নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন। বিশ্ব-ব্যাপী এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি এবং মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তির মধ্যে বিশাল সংখ্যক প্রবীণ এ ধরণের অবজ্ঞা, অবহেলা ও চিকিৎসার অভাবে প্রাণ হারিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফসহ বিভিন্ন সংগঠন করোনা দুর্যোগকালীন সময়ে প্রবীনদের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন নিয়ম/নির্দেশনা জারী করেছেন যা অবশ্যই পালনীয়। মহামারী আক্রান্ত প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবীণদের বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবার প্রয়োজন হয়। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, এজমা ও ক্যান্সার আক্রান্ত প্রবীণদের অতিরিক্ত সাবধনতা অবলম্বন করতে হবে। করোনা আক্রান্ত অনেক প্রবীণ ব্যক্তিকে চিকিৎসার অভাবে অবহেলিত ও পরিত্যাক্ত অবস্থায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। করোনা আক্রান্তদেরকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করা মানবতার অবমাননার শামিল।
পরম শ্রদ্ধা ও সম্মানের অধিকারী দেশের প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠরা। কারণ অতীতে তারাই দিবানিশি শ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে আমাদের গড়ে তুলেছেন। লেখাপড়া শিখিয়ে নির্বোধ থেকে বোধস¤পন্ন মানুষে পরিণত করেছেন। আজকের যুবককে কর্মক্ষম ও সচল করে তোলার জন্য প্রবীণ বা আমাদের বৃদ্ধ মা-বাবার অবদানই সব। কিন্তু প্রবীণ ব্যক্তিরা এখন দেশে বিভিন্ন স্থানে অনিরাপদ এবং নানা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। সামজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে প্রবীণরা আজ নিজ পরিবারেই তাদের সম্মান ও ক্ষমতা হারাচ্ছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশের দারিদ্রের হার বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে অস্বচ্ছল ও রোগাক্রান্ত প্রবীণরা মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীণ হচ্ছেন। তাঁদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্রমুক্ত, কর্মময় সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং ভৌত-অবকাঠামোর প্রবীনবান্ধব করণ অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের নবীন আগামী দিনের প্রবীণ। বার্ধক্যের হাত থেকে বাঁচার কোন সাধ্য না থাকার পরেও নিজের বার্ধক্য সম্পর্কে কেউ জানতে চান না, মানতে চান না, ভাবতে চান না। পাশাপাশি প্রবীণদের কেউ দেখতে চান না, বুঝতে চান না, কাছে যেতে চান না, তাদের সংগে সময় কাটাতে চান না, প্রবীণদের কল্যানে কাজ করতে বা অর্থ ব্যয় করতে কেউ আগ্রহী হন না। উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরকারি কর্তৃপক্ষ অনেক সময় তাদের অধিকার সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকেন।
বাংলদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবাই প্রবীণ। প্রবীণদের স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ, স্বাধীনতা, আত্মতৃপ্তি, সেবা, যত্ন ও দেখাশোনার বিষয়টি আজ খুবই ঝুঁকির সম্মুখিন। তবে বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট প্রবীণ বান্ধব। প্রবীণ নর-নারী জনগোষ্ঠীদের জন্য সরকারের কিছু কার্যক্রম রয়েছে। সবচেয়ে বড় কার্যক্রমটি হচ্ছে বয়স্কভাতা কার্যক্রম। যার আওতায় লক্ষ লক্ষ প্রবীণ নর-নারীকে মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেয়া হচ্ছে।
সামাজিক সম্মানবোধ ও মানসিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে করুণা করে নয় বরং শ্রদ্ধা মিশ্রত ভালোবাসা আর সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই সকল সন্তান তথা দায়িত্ব প্রাপ্তদের প্রবীণদের সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে হবে। অধিকারের প্রশ্নে নয়, বরং তাদের জীবনের শেষ ভাগ যেন সফল, স্বার্থক, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও আপনজনের সান্নিধ্যে কাটে তা নিশ্চিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হতে হবে। কারো জীবনের শেষ সময়টা যেন পরিবারহীন বৃদ্ধাশ্রমে না কাটে। বৃদ্ধাশ্রম যেন কোন বাবা মায়ের শেষ বয়সের ঠিকানা না হয় এই হোক আগামীর অঙ্গীকার।
—–
উপাচার্য
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়