জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের মূল লক্ষ্য থাকলেও তার বড় ছেলে শেখ কামাল ১৯৭৫ সালে এই নৃশংস হত্রাকান্ডে প্রথম শহীদ হন।
বঙ্গবন্ধুর ছেলে হিসেবে শেখ কামালের পরিচয় পাওয়ার পর মেজর (বরখাস্ত) বজলুল হুদা স্টেনগান দিয়ে ব্রাশফায়ারে তাকে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের রাষ্ট্রপক্ষের চতুর্থ সাক্ষী মোহাম্মদ কুদ্দুস সিকদারের জবানবন্দি থেকে জানা যায়, বজলুল হুদা ও নূর চৌধুরীসহ কয়েকজন প্রথমে বাড়িতে প্রবেশ করে।
সিকদার বলেন,বাসায় ঢুকে প্রথমেই তারা শেখ কামালকে দেখতে পায় এবং সাথে সাথে বজলুল হুদা তাকে স্টেনগান দিয়ে গুলি করে। শেখ কামাল বারান্দা থেকে অভ্যর্থনা কক্ষে পড়ে যান। সেখানে তাকে আবারও গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে খুনিরা।
বঙ্গবন্ধু ভবনের আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী ও হত্যা মামলার বাদী মহিতুল ইসলাম তার জবানবন্দিতে এ কথা উল্লেখ করেন।
মহিতুল ইসলাম ১৯৭২ সালের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে সহকারী হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৭৫ সালে পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্য মহিতুল তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারী কাম-অভ্যর্থনাকারী ছিলেন।
১৪ আগস্ট রাত ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৮টা পর্যন্ত তিনি ডিউটিতে ছিলেন।
১৫ আগস্টের হত্যাকান্ড সম্পর্কে মহিতুল বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৪টা বাজে। চারিদিক ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চারপাশে বৈদ্যুতিক আলো ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গুলি শুরু হয়।’
কিছুক্ষণ পর গুলি থেমে যায়। হাউসকীপার আবদুল ওরফে সেলিম বঙ্গবন্ধুর জন্য উপর থেকে পাঞ্জাবি ও চশমা নিয়ে এসেছেন, বঙ্গবন্ধু ওই পাঞ্জাবি ও চশমা পরে বারান্দায় এসে বললেন, আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এতো গুলি চালানো হচ্ছে, তোমরা কী করছ। তারপর তিনি উপরে যান।
শেখ কামাল ওপর থেকে নেমে এসে বললেন, ‘সেনাবাহিনী ও পুলিশ ভাই, আমার সঙ্গে আসুন। তখন তিন-চারজন ইউনিফর্মধারী সেনা সদস্য আসেন। ইউনিফর্ম পরা বজলুল হুদা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে । শেখ কামাল শেখ মুজিবের ছেলে হিসেবে পরিচয় দিলে তাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়।’
এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ মহিউদ্দিন আহমেদের ‘বাড়ি নং ৩২- মার্চ ২৫ থেকে ১৫ আগস্ট’ শিরোনামের বইতেও পাওয়া যায়।
বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিস্তারিত বিষয়ে হুদা বাতেন নামের একজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। বাতেন জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে থাকতেন।
১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের পর বজলুল হুদা তার বোনের বাড়িতে এসে বাতেনকে নিয়ে যান। বাতেন তার বোনের বাড়িতে রাত কাটান। বাতেনের সঙ্গে হুদা গণভবনের কাছে একটি সেনা ক্যান্টিনে নৈশভোজ করেন। সেখানে হুদা বাতেনের সঙ্গে মুজিব হত্যার কথা বলেন।
হুদার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি মেজর নূরের নেতৃত্বে শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাড়িতে হামলা চালান। গুলির শব্দ শুনে শেখ কামাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে হুদা তাকে হত্যা করে।
নিজ বাড়িতে হামলার পর বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। শেখ কামালকে হত্যার অনুরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের টেলিফোন কথোপকথন থেকেও।
১৯৮৭ এবং ১৯৯৩ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে পৃথক সাক্ষাতকারে, শফিউল্লাহ বলেছিলেন, তার বাড়িতে হামলার পর বঙ্গবন্ধু তাকে ফোন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সৈন্য পাঠাতে বলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘শফিউলল্লাহ, তোমার বাহিনী আমার বাড়িতে হামলা করেছে। কামালকে হত্যা করা হতে পারে। তাড়াতাড়ি তোমার ফোর্স পাঠাও।’
প্রবাসী লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ তার ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
শেখ কামালকে হত্যার পর মহিউদ্দিন ও তার সহযোগীরা বাড়িতে ঢুকে শেখ মুজিবকে খুঁজতে থাকে। অবশেষে সামনের বারান্দায় দেখা গেল তাকে। মুজিব হাতে পাইপ নিয়ে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে দেখে মহিউদ্দিন ভয় পেয়ে গেলেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে গুলি করতে পারলেন না। তিনি শুধু বললেন, ‘স্যার, আসুন আমাদের সাথে।’ সিঁড়ি থেকে বঙ্গবন্ধু নামতে শুরু করে বঙ্গবন্ধু চিৎকার করে বলেন, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? এ সময় মহিউদ্দিনকে পাশে থাকতে বলে হুদা ও নূর স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে।
ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ডান হাতে পাইপ ধরে সিঁড়িতে পড়ে যান। খুনিরা তার বুকের ডান পাশে ও পেটে গুলি করে। যখন সূর্য উদয় হতে চলেছে বাংলার গৌরব-সূর্য তখন অস্তমিত হয়েছিল ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও অভিযান শেষ হয়নি। মহিউদ্দিন, হুদা ও নূর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আজিজ পাশা ও মোসলেহউদ্দিন ল্যান্সার ও আর্টিলারি সৈন্য নিয়ে আসে। পাশা তার সঙ্গীদের নিয়ে দোতলায় যায়।
সুবেদার ওহাব জোয়ার্দার আগে থেকেই সেখানে ছিল। তারা শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও বাড়ির এক চাকরকে নিচে নিয়ে যায়। পাশা ও মোসলেহউদ্দিন স্টেনগান দিয়ে বেগম মুজিব, শেখ জামাল এবং কামাল ও জামালের স্ত্রীদের বেডরুমে গুলি করে।
পরে শেখ রাসেল মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলে পাশা একজন হাবিলদারকে রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে বলে। আর হাবিলদার রাসেলকে দোতলায় তার মায়ের কাছে গুলি করে হত্যা করে।