অতিরিক্ত ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে নরমাল ডেলিভারী করতে যেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উপকূলবর্তী খুলনার কয়রা উপজেলার প্রসূতি ও নবজাতক। অসচেতনতা ও দারিদ্রতার পাশাপাশি স্থানীয় অতিউৎসাহী ধাত্রীদের আশ্বাসে জটিল অবস্থায়ও প্রসূতিদের হাসপাতালে না নিয়ে রাখা হচ্ছে বাড়িতে। ফলে নবজাতক ও প্রসূতির ক্ষতির পাল্লা ভারী হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকার একাধিক প্রসূতির সাথে কথা বলে জানা যায়, এলাকাভিত্তিক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের কর্মীরা গর্ভবর্তীদের সেবায় উদাসীন। স্থানীয় কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গেলেও সন্তোষজনক সেবা পাওয়া যায় না। ফিল্ড কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যেয়ে শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের বিষয়ে পরামর্শ দেন এবং দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতি গ্রহণ করতে চাইলে হাসপাতালে নিতে খুবই আগ্রহ দেখান। তবে গর্ভবতীদের পরামর্শ কিংবা চেকআপে তারা চরম উদাসীন। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রেগুলোতে ডেলিভারীর কোন ব্যবস্থা নেই। অপরদিকে, কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনী চিকিৎসকের যথাযথ সেবা না পাওয়ার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। ফলে জটিল অবস্থায় প্রসূতিদের প্রাইভেট ক্লিনিক কিংবা শহরে চিকিৎসা সেবার জন্য যেতে হয়। এতে খরচ মেটাতে হিমসিম খেতে হয় দারিদ্রদের। এসব কারণে শেষ মূহুর্তে ডেলিভারীর জন্য বাড়িতে থাকছেন অধিকাংশ দারিদ্র মায়েরা। এলাকার ধাত্রী কিংবা এফডব্লিউভিদের বাড়িতে নিয়ে সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জটিল অবস্থায়ও টাকার লোভে এলাকার ধাত্রী ও পল্লী চিকিৎসকরা আশ্বস্ত করে বাড়িতে আটকে রাখেন রোগী। খরচের ভয়ে অনেকেই তাদের পরামর্শে ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে অবস্থান করেন। আবার কেউ কেউ ক্লিনিকে নিতে চাইলেও ধাত্রীদের অপকৌশলের কাছে পরাজিত হচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ধাত্রীদের অপচিকিৎসায় প্রসূতি পরবর্তী নানা জটিল সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি একাধিক নবজাতক এবং প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। জটিল অবস্থায়ও বাড়িতে রোগী আটকে রাখার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ পাওয়া গেছে ব্রাক কর্মী কাছিরার বিরুদ্ধে। কোন এলাকায় রোগী জটিল অবস্থার সম্মূখীন হলে অভিজ্ঞ ডাক্তার বাড়িতে আনার কথা বলে তাকে ডেকে নেন ধাত্রীরা। এছাড়া কেউ হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে নিতে চাইলেও দালালদের পরামর্শের কাছে হার মেনে কাছিরার শরানাপন্ন হন সাধারণ রোগী পরিবার। ডেলিভারীর সময় জটিল অবস্থায় বাড়ির লোক হাসপাতালে নিতে চাইলেও নিজের সক্ষমতার কথা বলে বাড়িতে আটকে রাখার ওস্তাদ তিনি। এছাড়া ধাত্রী ও পল্লী চিকিৎসকেরা নবজাতক ও প্রসূতির ক্ষতির দিকে না তাকিয়ে একের পর এক ব্যথার ইনজেকশন দেওয়ার ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্যথার চাপে মাতৃগর্ভেই একাধিক নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। অনাভিজ্ঞ ব্যক্তিদ্বারা মিনি সিজারসহ অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক প্রসূতি ও নবজাতক। গত মাসে কয়রা সদর ইউনিয়নের দেওলিয়া বাজার এলাকায় এক প্রসূতির নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ওই প্রসূতির প্রথম সন্তান সিজারের মাধ্যমে ভূমিষ্ট হওয়ার পরেও ব্রাক কর্মী কাছিরার আশ্বাসে দ্বিতীয় সন্তানের নরমাল ডেলিভারী করতে যেয়ে নবজাতক মারা যায়। ওই প্রসূতি জেসমিন নাহার বলেন, আমার প্রথম সন্তান সিজারের মাধ্যমে ভূমিষ্ঠ করা। এজন্য পরেরটিও সিজার করতে চেয়েছিলাম। তবে আমার মায়ের কথা রাখতে যেয়ে বাড়িতে নরমাল ডেলিভারীর চেষ্টা করা হয়। ডেলিভারীর সময় আমার সন্তান মারা যায়। তিনি বলেন, ব্যথা উঠার পরে আমি কাছিরাকে বলি আপনি পারবেন না। আগের বাচ্চাও বেধে গিয়েছিল, তখন সিজার করা লেগেছিল। বার বার হাসপাতালে নিতে বললেও তিনি নানা কথা বলে বাঁধা দেন।হাসপাতাল ও ক্লিনিক কোথাও ডাক্তার নেই এটা বলে জোর করে বাড়িতে আটকে রাখেন তিনি। জেসমিনের স্বামী নূরুন্নবী ভুট্টো বলেন, ক্লিনিকে যেয়ে ম্যানেজারের সাথে কথা বলে সিজারের জন্য সব রেডি করা ছিল। তবে আমার শাশুড়ির ব্রেন ওয়াশ করায় কাছিরা নামক ওই মহিলাকে ডাকেন। শ্বাশুড়ির কথামত প্রাথমিক অবস্থা দেখাতে যেয়ে আর ক্লিনিকে নিতে পারিনি। অবশেষে দরজায় লাথি দিয়েও আমার স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করতে পারিনি। জেসমিনের মা হাওয়া বিবি জানান, কাছিরা খুব আশ্বাস দিয়েছিল। কয়েকবার চেকআপ করে বলেছিলেন আগে সিজার থাকলেও তিনি নরমালে ডেলিভারী করতে পারবেন। এজন্য ব্যথা উঠার পরে প্রাথমিক অবস্থায় তাকে দেখতে বলেন। পরে হাসপাতালে নিতে চাইলেও নানা অযুহাতে হাসপাতালে নিতে দেননি। সেখানকার একাধিক প্রতিবেশি বলেন, তার স্বামী, পিতাসহ আমরা হাসপাতালে নেওয়ার জন্য জোর করলেও কাছিরা রোগী ছাড়েন নি। বরং হাসপাতালে ডাক্তার নেই, আর একটু দেরি করলে আমি পারবো। কোন সমস্যা হবে না – এমন নানা কথা বলে রোগী বাড়িতে ধরে রাখেন। কাছিরার অপচিকিৎসায় একই গ্রামের দিনমজুর গোলাম রসুল ও মুসলিমা দম্পতির নবজাতকও মারা যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। মুসলিমার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি ও ননদ রাশিদা বলেন, গরিব মানুষ, টাকা পয়সা নেই। ক্লিনিকে অনেক খরচ। তাই পাশের এক ধাত্রীকে ডাকি। তিনি ডাক্তারের (কাছিরা) মোবাইল নম্বর দিয়ে তাকে ডাকতে বলেন। পরে ডাক্তারকে ফোন করলে তিনি এসে বলেন, কোন সমস্যা হবে না। আমি পারবো। তার আশ্বাসে আমরা বাড়িতে রাখি। জানা যায়, কাছিরার বাড়ি কয়রা সদর ইউনিয়নে হলেও দালালদের মাধ্যমে তিনি অন্য ইউনিয়নে ডেলিভারীর জন্য যান। মহারাজপুর ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামেও এক নারী ডেলিভারীর সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে তিনি মারা যান। এছাড়া কয়রা সদরের এক হোটেল ব্যবসায়ী স্ত্রীর ডেলিভারীর সময় নবজাতক মারা যায়। তিনি বলেন, আমরা অনেক বললেও কাছিরা রোগী ছাড়েনি। একপর্যায়ে জোর করে ক্লিনিকে নিয়ে গেলে মৃত সন্তান বের হয়। সময়ের আগে ব্যথার ওষুধ দেওয়ায় নবজাতক পেটে মারা গেছে বলে ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ তাদেরকে জানান। ব্রাক কর্মী কাছিরার মোবাইলে কল দিয়ে কয়েকবার কথা বলা গেলেও বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি নানা অযুহাতে ফোন কেটে দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রতিবেদন বন্ধের সুপারিশ করিয়েছেন। ব্রাক অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। আর ব্রাক স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচি প্রকল্পের কয়রা অফিসের কর্মকর্তা মো. সাইফুজ্জামান মোবাইলে মন্তব্য করতে রাজি হননি। সম্প্রতি মহারাজপুর ইউনিয়নের দেয়াড়া গ্রামের নাজমা খাতুনেরও বাড়িতে ডেলিভারীর সময় পেটে নবজাতক মারা যায়। অজ্ঞতার কারণে ব্যথা উঠার পরেও দুইদিন তারা বাড়িতে অবস্থান করে। পরে একটি বেসরকারী ক্লিনিক থেকে সিজারের মাধ্যমে সন্তান অপসারণ করা হয়। কয়রা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা দপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে বাড়িতে ডেলিভারীর সংখ্যা ১৩২৭ জন। এর মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয় এমন ধাত্রীদের কাছে ডেলিভারী হন ১৫০ জন। উপজেলা পরিবার পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (অতি: দায়িত্ব) মো: আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ডেলিভারীর জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর সংখ্যা অনেক কম। এছাড়া কয়েকটি ইউনিয়নে কর্মী থাকলেও স্বাস্থ্য কেন্দ্র জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের মাঠ কর্মীরা মোটিভেট করলেও মানুষজন আসতে চায় না। তারা তাদের সাধ্যমত সেবা দিয়ে যাচ্ছে। কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেজাউল করিম বলেন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রাথমিক অবস্থায় বাড়িতে চেষ্টা করতে পারবেন। তবে যে কোন ধরণের জটিলতায় তারা হাসপাতালে রেফার্ড করবে। জোর করে বাড়িতে রাখার কিংবা তাদের নির্দেশনার বাইরে কিছু করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নিব। হাসপাতালে ডাক্তার থাকেনা এমন জনশ্রুতি বিষয়ে তিনি বলেন, ২৪ ঘন্টাই আমাদের মিডওয়াইফ থাকে। আর জটিল অবস্থায় আমাদের গাইনি কনসালটেন্ট রয়েছে। সিজারের প্রয়োজন হলে তিনি ব্যবস্থা নিবেন। তবে গাইনি কনসালটেন্টের আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারায় প্রতিদিন খুলনা থেকে আসা যাওয়া করছেন।