‘এই হল আমার, আমার কথাতেই হল চলবে। যাকে যেখানে খুশি সিট বরাদ্দ দিব। আপনাকে এই হলের দায়িত্ব কে দিয়েছে?’ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শেখ হাসিনা হলের প্রভোস্ট সাহেদুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে এমন মন্তব্য করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী ফাইজা মেহজাবিনের বিরুদ্ধে।
গত ৪ মার্চ সন্ধ্যা সাতটার দিকে শেখ হাসিনা হলের এক শিক্ষার্থীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে হল পরিদর্শনে এসে সমস্যা সমাধানে ফাইজার সাথে কথা বলতে গেলে ফাইজা এমন মন্তব্য করেন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের সূত্রমতে জানা যায়, শেখ হাসিনা হলের ২১৪ নম্বর রুমের আবাসিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের ১২ তম আবর্তনের প্রেয়শী সানা অন্য রুমে শীফট হওয়ার জন্য হল প্রভোস্ট বরাবর আবেদন করলে তাকে ২১৬ নম্বর রুমের একটি সিটে এলটমেন্ট দেয়া হয়। কিন্তু রুম শীফট করতে গিয়ে প্রেয়শী তার নতুন সীটে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ১১ তম আবর্তনের রায়হানা আনজুম মিম নামে এক শিক্ষার্থীকে অবস্থান করতে দেখেন। ঘটনা সমাধানের জন্য হল প্রভোস্টকে ফোন দিলে হল প্রভোস্ট সাহেদুর রহমান হলে এসে ১১ তম আবর্তনের শিক্ষার্থীকে এখানে অবস্থানের কারন জিগ্যেস করলে তিনি কাজী ফাইজা মেহজাবিনের নাম বলেন। সেই সূত্র ধরে লোক প্রশাসন বিভাগের স্নাতকোত্তরের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী ফাইজা মেহজাবিনকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি উপরোল্লিখিত মন্তব্য করেন প্রভোস্টকে উদ্দেশ্য করে।
এ সময় হলে অবস্থারত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন,” ফাইজার এমন আচরণ নতুন কিছু না। সে একজন শিক্ষক সম্পর্কে এমন মন্তব্য করতে পারে তাহলে ভাবুন আমাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করে থাকে? প্রতিদিন সকাল বেলা তার চিল্লাচিল্লিতে আমাদের ঘুম ভাঙে। হলে অবস্থানরত সকল শিক্ষার্থী তার প্রতি বিরক্ত। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারে না। ”
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা উক্ত হলের হাউজ টিউটর মো. আল আমিন বলেন, ‘হল প্রভোস্টের সাথে ফাইজার আচরণ শিক্ষার্থী সুলভ নয়।’
এ ব্যাপারে কাজী ফাইজা মেহজাবিন বলেন, ‘ স্যারকে এই ধরনের কোন কথা বলিনি। কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম এই হল তো আমারও।’
এ ব্যাপারে হল প্রভোস্ট সাহেদুর রহমান বলেন, ‘ হলে কোন শিক্ষার্থী উঠবে আর কোন শিক্ষার্থী উঠবে না, এই এখতিয়ার সম্পূর্ন হল প্রসাশনের। একজন শিক্ষার্থী তো এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে হল সংস্কৃতি আমরা তৈরি করতে চাচ্ছি তা শুধুমাত্র সম্ভব হচ্ছে না ফাইজার জন্য।’
শেখ হাসিনা হল শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এর আগেও নানা ইস্যুতে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন তিনি। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গত বছরের ৩১ জুলাই শেখ হাসিনা হলের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনের আগে শেখ হাসিনা হলে উঠতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ভাইবা নিয়ে সিটে উঠানো হয়। কিন্তু হল উদ্বোধনের পর থেকেই ফাইজা নিজের খেয়াল খুশিমতো সিট বদল করতে থাকেন। এছাড়া বরাদ্ধকৃত সিটে না উঠতে হুমকি দেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে সেই সকল সিটে নিজের খেয়ালখুশি মতো শিক্ষার্থী তোলার ঘটনা রয়েছে। শুধু তাই নয়, হলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীরা রাত নয়টার পর হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারবে না, হল গেটে শিক্ষার্থীদের কেউ এগিয়ে দিতে পারবেনা সহ নানা ধরনের নিয়ম তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের হল প্রশাসন সিট দিয়েছে। কিন্তু ফাইজার কথা হচ্ছে সেই সিট বাঁচিয়ে রাখতে গেলে নাকি ছাত্রলীগ করতে হবে! যারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না তাদের সিট নিয়ে সে বরাবর ঝামেলা করে। ”
খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে , বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬তম আবর্তনের কোন শিক্ষার্থীকে শেখ হাসিনা হল প্রশাসন সিট বরাদ্ধ দেয়নি। কিন্তু কাজী ফাইজা মেহজাবিন হলে সিঙ্গেল সিট নিয়ে অবস্থানরত অন্যান্য শিক্ষার্থীদের বাধ্য করছে ১৬ তম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের সাথে একই সিটে থাকার জন্য। এছাড়া কোন শিক্ষার্থী পাঁচ থেকে দশদিনের জন্য বাড়ি গেলেই তার সিটে অন্য কাউকে তুলে দেয়ার ঘটনাও তিনি ঘটিয়েছেন। পরবর্তীতে হল প্রসাশনের সহযোগিতা নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের সিট বাঁচিয়েছেন। এখন পর্যন্ত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র শেখ হাসিনা হলে কোন গনরুম নেই। তবে নিজেকে শক্তিশালী করতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করতে হলের গেম রুমকে গনরুম বানানোর পরিকল্পনাও করছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী বলেন, “আমি চার থেকে পাঁচদিনের জন্য আমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আমাকে ফোন দিয়ে বলে হলে না আসলে নাকি আমার সিট বাতিল করে দিবে। আমার সিট বাতিল করার সে কে? সেও শিক্ষার্থী, আমিও শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে হল প্রসাশনের সাথে কথা বলে আমি আমার সিট বহাল রেখেছি।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শেখ হাসিনা হল শাখা ছাত্রলীগের সংক্ষিপ্ত কমিটির একজন বলেন, “গেম রুমকে গনরুম বানাবে বলে শুনেছি। এই বিষয়ে প্রভোস্ট স্যারের সাথে ফাইজার কথা কাটাকাটিও হয়েছে যতদূর জানি।”
এ ব্যাপারে কাজী ফাইজা মেহজাবিন বলেন,’ আমি এরকম কিছুই করি নাই। হলের সিটে এলটমেন্ট তো আমি দেই না। হলে প্রশাসন দেয়। আমাদের হলে অবৈধ কিছু হয় না।’
হল প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে , শেখ হাসিনা হল উদ্বোধনের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও প্রথম আসন বরাদ্দের লিস্টে নাম আসা শিক্ষার্থীদের মধ্যে শুধু কাজী ফাইজা মেহজাবিন তার ১,২৫০ টাকা হল প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেয়নি। বিষয়টি হল প্রসাশনের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ ব্যাপারে হল প্রভোস্ট মো. সাহেদুর রহমান বলেন, সবাই দিলেও সে হল প্রশাসনকে এই টাকা বুঝিয়ে দেয়নি। আমি বেশ কয়েকবার বলেছি কিন্তু সে নানা অজুহাতে দেখায়। নিয়ম অনুযায়ী তার সিট বাতিল হওয়ার কথা। আমি তার সাথে এই ব্যাপারে সামনে কথা বলবো। হল প্রশাসনকে টাকা বুঝিয়ে না দিলে আমি তার সিট বাতিল করার প্রক্রিয়ার দিকে আগাব।
এ ব্যাপারে ফাইজা বলেন, আমার টাকা কিছু বাকি ছিল। সেটা আমি দিয়ে দিয়েছি। স্যার সম্ভবত এখনো বিষয়টি পাননি।
সার্বিক অভিযোগের ব্যাপারে হল প্রভোস্ট মো. সাহেদুর রহমান বলেন, অনেক মেয়ে নানা সময় তাকে নিয়ে আমাকে অভিযোগ করেছে। তখন মেয়েদের আমি বুঝিয়েছি লিখিত ডকুমেন্ট দিলে আমার ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়। কিন্তু মেয়েরা এখানে পড়তে এসেছে। তাদের পরবর্তী সময়ে অসুবিধার কথা চিন্তা করে আর কোন অভিযোগ করেনি। তাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নিতে পারিনি।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেন,
এখানে পরস্পর মুখী বক্তব্য আছে। প্রভোস্ট স্যারও নাকি ছাত্রলীগ সম্পর্কে বাজে কথা বলেছে। এখানে দুইজনের দুই রকমের বক্তব্য শুনছি। আমরা তদন্ত করে দেখব এবং যদি ফাইজা এমন কিছু বলে থাকে তাহলে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিব। হল ছাত্রলীগের না, হল প্রশাসনের প্রশাসন চালাবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা যেহেতু প্রগতিশীল রাজনীতি করি এখন কয়েকটা মেয়ে হলে ছাত্রলীগের ব্যানারে উঠুক আমরাও চাই। যেহেতু হলে সীট সংকট এখন যদি কোনো মেয়ে হলে উঠতে চায় সেহেতু গনরুমকে আমরা সাংগঠনিকভাবে পজিটিভ ভাবেই দেখি।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেন, হল চালাবে প্রশাসন। শিক্ষার্থীরা এখানে আসবে কেন? আমি বিষয়টা অবগত হয়েছি। বিষয়টা আলোচনা করে দেখবো।
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা হল ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথেও খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ রুয়েছে কাজী ফাইজা মেহজাবিনের বিরুদ্ধে। বাসে থাপ্পড় মারার ঘটনাও রয়েছে এর মধ্যে। গত বছরের নভেম্বরের ৯ তারিখ বাসে সিট রাখাকে কেন্দ্র করে এক ছেলে শিক্ষার্থীকে থাপ্পড় দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে সেই শিক্ষার্থীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ছাড় পান এই ছাত্রলীগ নেত্রী।