‘মানুষের জীবন ধাপে ধাপে বিভক্ত। এইতো সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম, আজ বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে এইতো মাত্র কিছুদিন আগেই ভর্তি হয়েছিলাম। ডিপার্টমেন্টের জুনিয়রদের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞতা থাকবে এমন সুন্দর একটি আয়োজন আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। যতটুকু শ্রম দেওয়া যায় একটা প্রোগ্রামের পেছনে তার চেয়ে অনেকটা বেশি দিয়েছে তারা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো অংশেই কমতি ছিল না। বিদায় যে এমন সুন্দর হতে পারে সেটা আমার নতুন উপলদ্ধি। প্রথমবারের মতো এমন আয়োজন হয়েছে যেটার স্বপ্ন আমরা দেখে আসছি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই। আশা করি এমন বন্ধন অটুট থাকবে সবসময়।‘ কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী শাকিল সাদমান।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ (বিএমএস) বিভাগের প্রথম ব্যাচের বিদায়ী শিক্ষার্থীদের ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠান ‘সান্বয়’ এর আয়োজন করা হয়েছে। দিনটিকে স্মৃতিময় করে রাখতে রঙিনভাবে সাজিয়ে তোলা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস অডিটোরিয়াম। পাঁচ বছর আগে যেসব অচেনা মুখ বুকের মধ্যে লালিত স্বপ্ন নিয়ে ক্যাম্পাসে আগমন করেছিল, সময়ের স্রোতে বাস্তবতার টানে আজ তারা বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে। ক্যাম্পাসের পথচলায় সর্বদা অনুপ্রেরণাদায়ী বড় ভাইদের বিদায় দিতে জুনিয়রদের মধ্যেও যেন অব্যক্ত কষ্ট ফুটে উঠছিল।
এর আগে গত (২২ ফেব্রুয়ারি) সান্বয়ের প্রথম দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে রঙিন আয়োজনে কালার ফেস্ট প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়। বিদায়ীদের সাথে আনন্দে মেতে উঠে জুনিয়ররাও। নাচে গানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ দর্শকশ্রোতায় ভরপুর হয়ে যায়।
সান্বয়ের দ্বিতীয় দিন (২৩ ফেব্রুয়ারি) প্রথম পর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস অডিটোরিয়ামে বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। অনুষ্ঠানে বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. দিব্যদ্যুতি সরকারের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিদার উল আলম। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ স্টাডিজ বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ক্যারিয়ারের প্রতিটি অধ্যায়ে তারা যেন বিজয়ের চিহ্ন রেখে যায়। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই বিভাগের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে দেশে বিদেশে। বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. দিব্যদ্যুতি সরকারের বক্তব্য প্রদানের সময় প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। এ যেন প্রথম সন্তানের সাথে পিতার সম্পর্কের মতো!
দুপুরে খাবারের পর্ব শেষে বিকেল থেকে অডিটোরিয়ামে শুরু হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকেল হতেই সবাই একে একে জড়ো হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়াম প্রাঙ্গণে। পুরো অডিটোরিয়াম প্রাঙ্গণ লোকে লোকারণ্য। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে রাত সাড়ে ৯টার দিকে মঞ্চে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের দল ‘ভয়েজার’।
একে একে ভয়েজারের ভোকাল সজল ভাই বিভিন্ন জনপ্রিয় ব্যান্ডের গান গেয়ে দর্শক মাতালেন। হেড ব্যাং দিতে দিতে সবার অবস্থা শোচনীয়, তবু থামার নাম নেই। ড্রাম, গিটার, কি-বোর্ডের সুরতাল, রঙ-বেরঙের আলোর খেলায় সবার হারিয়ে যাওয়ার মতো আত্মহারা হওয়ার উপক্রম।
দর্শক-শ্রোতা যেন উল্লাসে ফেটে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে এই অনুষ্ঠানে অডিটোরিয়ামে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় ছিল সবচেয়ে বেশি। ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী নুর আহমেদ সাগর বলেন, অডিটোরিয়ামে বিগত দিনের অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর অনুষ্ঠান হয়েছে সান্বয়। ম্যানেজম্যান্ট ইনফরমেশন সাইন্স বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী নাদিমুর রহমান বলেন, অডিটোরিয়ামের বিগত দিনের যেকোনো অনুষ্ঠানের চেয়ে সবচেয়ে সুন্দর অনুষ্ঠান ছিল সান্বয়। দর্শকদের এত উপচে পড়া ভিড় অতীতে দেখা যায়নি।
সবকিছুর মতো ধীরে ধীরে এই উৎসবেরও বেলা শেষ হয়ে আসে। উপস্থিত হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নিজেকে শক্ত প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টায় থাকা বিদায়ী শিক্ষার্থীটিরও একসময় নোনাজলে চোখ ভিজে যায়। সজল ভাইয়ের কভার করা ‘পুরনো সেই দিনের কথা’ গানের মধ্যে হঠাৎ কারও কারও হুহু করে কান্নার আওয়াজ শুরু হয় বিদায়ী শিক্ষার্থীদের মাঝে। একে একে প্রথম ব্যাচের সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নায় ভেঙে পড়েন জুনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও।
চলার পথে পাঁচটি বছরের সাথী ছিল যারা, আগামীর পথচলায় তাদের সবাইকে পাশে পাওযার প্রত্যয় ব্যক্ত করার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় ” সান্বয়”। আনুষ্ঠানিক বিদায় হলেও বিএমএস ১ম ব্যাচের শিক্ষার্থীগণ নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে সকলের অন্তরের মণিকোঠায় শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার আসনে আসীন থাকবেন আজীবন।