২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর। মধ্যরাত পার হয়ে আলো ফুটতেই নিষ্ঠুর এক হত্যাকাণ্ডে কলঙ্কিত হয় শিক্ষাঙ্গন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে পৈশাচিক নির্যাতন করে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়। র্যাগিংয়ের নামে বর্বর এ হত্যাকাণ্ডে থমকে গিয়েছিল দেশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে শিক্ষার্থীর হাতে শিক্ষার্থী হত্যার এ ঘটনার বিচার চলছে। কিন্তু এর পরও চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা। র্যাগিংয়ের ঘটনায় আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
গত রবিবার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের এক ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ ও রাতভর নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা, ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী তাবাসসুমসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তোলপাড় চলছে দেশজুড়ে। শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাই কোর্ট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) গত মঙ্গলবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের সিট নিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায়কে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। এতে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সোলাইমান তাকে শিবির বলে গালি দিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেন। এ নিয়ে প্রতিবাদে উত্তাল পুরো ক্যাম্পাস। প্রায়ই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় উৎকণ্ঠা বাড়ছে অভিভাবকদের মধ্যে। সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়ে আতঙ্কে দিন পার করছেন তারা। এসব অস্থিরতায় বিঘ্নিত হচ্ছে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ, বাড়ছে উদ্বেগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থেকে পড়াশোনা করতে আগ্রহ হারাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন গণরুমে থাকা অন্য শিক্ষার্থীরা। ভয়ে এবং পারিবারিক চাপে অনেক ছাত্রী বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। হল সূত্রে জানা যায়, দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে আবাসিক আসন সংখ্যা ৫৬৮টি। গণরুমসহ ৮৭৮ ছাত্রী হলে থাকেন। ছয়টি গণরুমে থাকেন অন্তত ১৩৪ জন। হলের গণরুম দোয়েল-১ নামে একটি কক্ষে ছাত্রী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ওই কক্ষে থাকেন ১৬ জন। তবে এখন ৫-৬ জন আছেন। প্রতিটি গণরুমে ১৫-১৬ জন করে থাকলেও এখন ৪-৬ জন করে আছেন।
ভুক্তভোগী ছাত্রীকে নির্যাতনের ভয়াবহতার বর্ণনা দেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী। তিনি বলেন, ওই ছাত্রীকে থাপ্পড় মেরে নির্যাতনকারীরা বলে, ‘তোর যে চেহারা, কুকুর ছাড়া কেউ তাকাবে না। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। গণরুমের ওপরের দেয়াল ভাঙা থাকায় স্পষ্ট শুনতে পেয়েছি। মারপিটের শব্দ ও গালিগালাজ শুনে আমরা কেঁদে ফেলেছিলাম।’ নির্যাতনের পরের দিন ভয়ে ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যান ভুক্তভোগী ছাত্রী। নিরাপত্তার আশ্বাসে গতকাল ক্যাম্পাসে ফিরেছেন ভুক্তভোগী। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে নিরাপত্তা দিতে হাই কোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। হাই কোর্টের নির্দেশে নিরাপত্তা নিশ্চিতের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে ওই ছাত্রীকে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ইবির প্রক্টর ড. শাহাদৎ হোসেন আজাদ বলেন, ‘হাই কোর্টের নির্দেশে আমরা ভুক্তভোগী ছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তাকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি।’ গত মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে সিট নিয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র কৃষ্ণ রায়কে নির্যাতনের পাশাপাশি শিবির তকমা দিয়ে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ ওঠে। এতে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সোলাইমানসহ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে সেদিনই তদন্ত কমিটি গঠন করেছে হল প্রশাসন। তবে এ ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে পুরো ক্যাম্পাস। গত বৃহস্পতিবার এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ক্যাম্পাসে কয়েক দফা আন্দোলন করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বাম ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। অনশনে বসেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, কারও বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নতি এবং শিক্ষার্থী পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ বৃদ্ধি করা জরুরি। যার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা সম্ভব। হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘হলে শিক্ষার্থী হয়রানি কিংবা নির্যাতন খুবই জঘন্য কাজ। এ ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুতই জমা দেওয়া হবে।’ সোহরাওয়ার্দী হলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ ও সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলামসহ ছাত্রলীগের ৭০ জনের বেশি নেতা-কর্মী অবৈধভাবে হলে থাকছেন। হল প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই মাসে হলে সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তখন ৪৪ জনকে হলে তোলার চেষ্টা করে প্রশাসন। তবে ছাত্রলীগের বাধায় ২০ শিক্ষার্থীকে তোলা সম্ভব হয়। এবারও হলে আসন বরাদ্দের নোটিস দেওয়া হয়েছে। হলে ইতোমধ্যে ১১৭টি সিট খালি হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর বেশির ভাগ ছাত্রলীগের দখলে। কক্ষ দখলের ব্যাপারে নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, ‘তারা বৈধভাবে সিট পাওয়ার জন্য একাধিকবার আবেদন করেছেন। কিন্তু প্রাধ্যক্ষ ছাত্রলীগকে হলে সিট বরাদ্দ দিচ্ছেন না।’ বিষয়টি অস্বীকার করে প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, তাদের কোনো আবেদন আমি পাইনি। তবে এ ঘটনার পর অনেকে সিট বরাদ্দের জন্য যোগাযোগ শুরু করেছে।’ প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, হলে ছাত্র নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। ইতিপূর্বে এমন কয়েকটি ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন শৃঙ্খলা কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। খুব শিগগিরই সিদ্ধান্ত আসবে।’