দেশব্যাপী ডেঙ্গু জ্বর ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সমন্বিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না এডিস মশা। বিশেষজ্ঞদের মতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ একমাত্র বৈজ্ঞানিক উপায়ে সম্ভব। কিন্তু এই দেশে তা না করে মশা নিধনে উল্টোপথে হাঁটছে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ। এডিস মশার কামরে ডেঙ্গু জ্বর হয় এই বিষয়টি সকলে জানে। এই চিহ্নিত শত্রু নিধনে যে কার্যক্রম দরকার, সেই কার্যক্রমে যারা জড়িত তাদের নেই বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা। তারা শুধু জ্ঞান বিতরণ করে বেড়াচ্ছে। এ নিয়ে চিকিৎসকরা বিরক্ত। মশা নিধনে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারেন কীটতত্ত্ববিদরা। অথচ তাদেরকে কাজে না লাগিয়ে মশা নিধনে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে, এ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান রাখেন না এমন ব্যক্তিদের। জানা গেছে, মশা বা কীট নিয়ে ধারণা নেই এমন কর্মকর্তাদের একটি গ্রুপ অবকাঠামো নির্মাণের নামে নতুন প্রকল্প তৈরি করার পাঁয়তারা করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নিধনে অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা চালু করে একশ্রেণির অনভিজ্ঞ কর্মকর্তা প্রকল্পের টাকা লুটপাট করার পাঁয়তারা করছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, মশা নিধন কার্যক্রম কীটতত্ত্ববিদদের ছাড়া চিন্তা করা যায় না। অথচ এই কার্যক্রমে তাদের রাখা হয়নি। বাংলাদেশে সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম) প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর নানা বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বিশেষজ্ঞ লোকজন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা সারাদেশে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এই প্রতিষ্ঠানটি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের জনবলকে কাজে লাগানো হয়নি। করোনা মহামারিকালে নিপসম ও আইইডিসিআর ভূমিকা বেশ প্রশংসিত হয়েছে। ২০০০ সালে এদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। এতো বছর পরেও মশা নিধনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তাদের ব্যর্থতার কারণে ঢাকাসহ দেশব্যাপী ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়ছেই। দ্বিগুণ হয়েছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারের যে তথ্য দিচ্ছে, প্রকৃত অর্থে তা মোট আক্রান্ত ও মৃত্যুর তিনভাগের এক ভাগ বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়। ওই তথ্যের সাথে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একমত নয়। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চাপে বেড দেওয়ার জায়গা নাই। ঢাকার বাইরেও একই অবস্থা। গত বুধবার ডেঙ্গু জ্বরে আরও নয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৩৫ জনের মৃত্যু হলো। হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ১৩৯ জন। এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৯২ হাজার ২৪ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু এখন বর্ষা মৌসুমের আতঙ্ক নয়। সারা বছরই এর প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, মশা নিধন নিয়ে শুধু বকবক চলছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মশা নিধন যাদের কাজ, তাদের দিয়ে করলে এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, মশা নিধন প্রযুক্তির মাধ্যমে করতে হবে। এ কাজে কীটতত্ত্ববিদদের সংযুক্ত না করায় নিয়ন্ত্রণে বড় ঘাটতি রয়েছে। সিটি করপোরেশনের কর্মীরা ড্রেনের মশা মারতে পারে। কিন্তু এডিস মশা ধ্বংসের কাজ আলাদা। ১৯৬০ সালে সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা সনাক্ত করা হয়। কীটতত্ত্ববিদদের সমন্বয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যক্রম চালিয়ে সিঙ্গাপুর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। একই ব্যবস্থাপনা ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রয়োগ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করছে। এখনি এমন ব্যবস্থা না নিলে সামনে ডেঙ্গু আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে। জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা ব্যতীত মশা নিধন সম্ভব নয়। হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীকে মশারির মধ্যে রাখতে হবে। এই রোগীকে মশা কামড়ালে সেই মশা অন্য রোগীকে কামড়ালে সেও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হবে। হাসপাতালের রোগীকে নিরাপদ রাখতে পুরা ভবনকে নেটের আওতায় আনতে হবে। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। নিপসমের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, নদীর পানি ছেড়ে বাধ দিলে যে অবস্থা হয় বর্তমানে মশা নিধনের কার্যক্রম একই অবস্থা। মশা নিধনের ওষুধ নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে। বৈজ্ঞানিকভাবে মশা নিধনের অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। বৈজ্ঞানিকভাবে মশা নিধনের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এডিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।