চৈত্রের শেষে বাংলা নতুন বছরের শুরুতে অসহনীয় দাবদাহে পুড়েছে দেশ। তীব্র গরমে কৃষি, প্রাণ ও প্রকৃতি ছিল বিমর্ষ। এখন কিছুটা সহনীয় প্রকৃতিতে মিলছে বৃষ্টি। বাতাসে দোল খাচ্ছে বোরো ধানখেত। প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় ফুরফুরে মেজাজে কৃষকরা শুরু করেছেন ধান কাটা ও মাড়াই। রংপুরে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ছাড়িয়েছে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা। জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন চাল অতিরিক্ত থাকবে। তবে ফলন ভালো হলেও ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত কৃষকরা। উৎপাদন বেশি হলে কম দামে ধান-চাল বিক্রি করতে হয় তাদের। এতে মাঠের হাসি হাটেই শেষ হওয়ার শঙ্কা থাকে বেশি। বর্তমানে বোরো ধান কোথাও সতেজ হয়ে সবুজ, আবার কোথাও হলুদ রং ধারণ করেছে। বিস্তীর্ণ ধানখেতে সবজু-হলুদ বর্ণে দোল খাচ্ছে সেচনির্ভর বোরো ধান। কিছু কিছু এলাকায় আগাম রোপণ করা বোরো ধান কাটা হয়েছে। বৈশাখের মাঝামাঝি এ সময়ে রংপুরে প্রকৃতি অনুকূলে থাকায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। আর অল্প কিছু দিন পর পুরোদমে শুরু হবে ধান কাটা ও মাড়াই উৎসব। বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) রংপুর নগরের মাহিগঞ্জ, সরেয়ারতল, আমাশু কুকরুল, সদর উপজেলার হরিদেবপুর, পানবাজার, পাগলাপীর, পীরগাছার তাম্বুলপুর, সাতদরগাসহ বেশকিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, যতদূর চোখ যায় বৈশাখের হালকা বাতাসে ধানের শীষে দোল খাচ্ছে সবুজ-হলুদ বর্ণ বোরোর চাদর। যেন সোনালী ধানে ভরপুর ফসলি মাঠ। পীরগাছার সাতদরগা এলাকার ধানচাষি নূর হোসেন প্রতি বছরের মতো এবারো বোরো ধান আবাদ করেছেন। তবে গত বছরের তুলনায় এবার তার আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে। এই কৃষক জানান, প্রায় দুই একর জমিতে সেচের পানি, সার, ধান কাটাসহ তার খরচ পড়েছে ৯০ হাজার টাকা। কয়েক দিন আগ থেকে ধান কাটা শুরু করেছেন। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বেশি দামে সার-ডিজেল কেনা ও সেচসহ ধান চাষে এবার খরচ বেড়েছে। তবে একরপ্রতি ৭০ মণ ধান উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় খুশি এই চাষি। সদর উপজেলার পানবাজার এলাকার আশরাফুল ও নজিবুল। দুই ভাই মিলে বর্গা নেওয়া জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। ধানখেতে তেমন পোকামাকড়ের আক্রমণ না থাকায় খুশি তারা। সময়মতো খেতে পানি, সার দিয়েছেন। ইতোমধ্যে দেড় একর জমির অর্ধেক ধান কাটা শেষ হয়েছে তাদের। নজিবুল আলম বলেন, আগাম জাতের বোরো ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। অনেকেই স্বল্প পরিসরে হাট-বাজারে ধান বিক্রি করছেন। বাজারে যে দামে ধান-চাল বিক্রি হচ্ছে তাতে উৎপাদন খরচ উঠবে না। এমনকি সরকার ধান-চালের যে দাম নির্ধারণ করেছে, তাতেও পোষাবে না। আবার উৎপাদন বেশি হলে কম দামে ধান-চাল বিক্রি করতে হবে। তখন তো লোকসানের সম্ভাবনা থাকে। মিঠাপুকুরের জায়গীরহাটে ধান বিক্রি করতে আসা বিটুল মিয়া বলেন, বর্তমানে হাটে খুব বেশি ধান উঠা শুরু হয়নি। অল্প পরিমাণে ধান বেচাকেনা হলেও দাম ভালো যাচ্ছে। এই হাটে ৮৫০ থেকে ১ হাজার ৫০ টাকা পর্যন্ত মণপ্রতি বিক্রি হচ্ছে। আরও মাসখানেক পর পুরোদমে ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হলে ধান বেচাকেনা জমে উঠবে। এই ধানচাষি জানান, হাটে বর্তমানে প্রতিমণ মোটা ধান আট শ থেকে নয় শ টাকা এবং চিকন ধান এক হাজার থেকে এক হাজার ১০০ টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। একর প্রতি ২০ হাজার লাভ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রংপুর নগরের মাহিগঞ্জ সরেয়ারতল এলাকার ধানচাষি বুলবুল বলেন, এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে সারের দাম বেড়েছে। সেইসঙ্গে জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য ডিজেলসহ অন্যান্য খরচও বেড়েছে। বর্তমানে ধান রোপণ করা থেকে কাটা পর্যন্ত শ্রমিকদের মজুরি বেশি। ধান চাষ করতে এবার অনেক বেশি খরচ হয়েছে। এসবের মাঝেও ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছি। কৃষকদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করা সংগঠকদের ধারণা, উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা না গেলে ধান চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে কৃষকরা। এতে সামগ্রিক প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। তাই কৃষকরা যাতে ধানের ন্যায্যমূল্য পায় তা নিশ্চিত করার উপায় বের করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন কৃষক সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ। এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রংপুর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। ইতোমধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ১৮৪ মেট্রিক টন। গত বছর ছিল ৫ লাখ ৫৯ হাজার ৭৭৫ মেট্রিক টন। এবার গত বছরের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১৫ হাজার ৪০৯ মেট্রিক টন ধান বেশি হবে। এবার প্রতি হেক্টরে ৪ দশমিক ৩২ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় ধান কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, এ বছর প্রকৃতি এখনো অনুকূলে রয়েছে। প্রতিনিয়ত কৃষকদের পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কৃষকেরাও প্রতিনিয়ত দক্ষতা অর্জন করেছেন। এসব নানা কারণে চলতি মৌসুমে অন্য জেলার চাইতে রংপুরে বোরো ধানের ফলন অসম্ভব ভালো হয়েছে। এবার ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা গত বছরকেও ছাড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, চলতি মৌসুমে বিআর-২৮, বিআর-২৯, বিআর-৮১, বিআর-৮৮, বিআর-৮৯ জাতের ধান ছাড়াও হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ হয়েছে। জেলায় চালের চাহিদা আছে প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন। এবার উৎপাদন হবে পাঁচ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৩ লাখ মেট্রিক টন চাল অন্য জেলার চাহিদা মেটাবে। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।