উপজেলা রেজিষ্ট্রি অফিসে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর বা দলিলের সময় ইউনিয়ন পরিষদের কোষাগারে জমা এক শতাংশ (১%) টাকা সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় না করে কক্সবাজারে প্রমোদ ভ্রমণের অভিযোগ উঠেছে। এ ভ্রমণে পরিবারসহ অংশ নেন ইউএনও, চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যসহ অন্তত ৩০০ জন। উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা ও পরিষদের সকল সদস্যরা পাঁচ দিনব্যাপী এ ভ্রমণের আয়োজন করেন। ব্যয় মেঠানো হয় স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর বা জমি রেজিষ্ট্রির ইউনিয়ন পরিষদের এক শতাংশের (১%) টাকা উত্তোলন করে। ঘটনাটি ঘটেছে গাইবান্ধা জেলার অন্যতম গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়ভাবে আলোচনার ঝড় উঠেছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক অলিউর রহমান বলেন, এক শতাংশের টাকায় ভ্রমণের কোন বিধান নেই। এই টাকা ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে ব্যয় করতে হবে। ওই টাকা দিয়ে প্রমোদ ভ্রমণ হয়ে থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদের কক্সবাজার ভ্রমণ সূচিতে জানা যায়, গত ১ মার্চ দুপুর আড়াইটায় গোবিন্দগঞ্জ থেকে বাসযোগে যাত্রা শুরু হয়। ভ্রমণ শেষে ৬ মার্চ সকাল ১০টায় কক্সবাজার থেকে গোবিন্দগঞ্জে ফেরেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভ্রমণকারীরা জানান, ইউএনওসহ উপজেলা পর্যায়ের ১৩ জন কর্মকর্তা, অসংখ্য কর্মচারী ও ১১ জন ইউপি চেয়ারম্যান ও তাদের পরিবারসহ প্রায় ৩০০ জন প্রমোদ ভ্রমণে অংশ নেন। পরিষদের আমন্ত্রণে কক্সবাজারে ভ্রমণে অতিথি ছিলেন গোবিন্দগঞ্জ আসনের সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যান। রির্জাভ করা ছয়টি যাত্রীবাহী চেয়ার কোচে প্রায় ২৫০ জন এবং বাকি ভিভিআইপিরা বিমানযোগে কক্সবাজার যাতায়াত করেন। এছাড়া একটি ট্রাক ভাড়া করা হয়। সেখানে ছিলেন প্রায় আটজন বাবুর্চি, ১০টি খাসি ও রান্নার অন্যান্য মালামাল। তবে উপজেলার চারজন ইউপি চেয়ারম্যান ও আটজন কর্মকর্তা জানান, এ ভ্রমণে ১২ জন উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা প্রায় ৬০ হাজার টাকা চাঁদা দেন। এছাড়া আর কারো কাছ থেকে কোনো চাঁদা নেয়া হয়নি। উপজেলার মোট ১৭টি ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর বা জমি রেজিষ্ট্রি করের ইউনিয়ন পরিষদ অংশের এক শতাংশের ১৭ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে। কোন কোন চেয়ারম্যানের কাছে বেশি টাকা নেয়া হয়েছে। কিন্তু ৩০০ জনের পাঁচ দিনব্যাপী যাতায়াত, থাকা-খাওয়া মিলে মোট আনুমানিক ২৮ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান ইউনিয়ন পরিষদ অংশের এক শতাংশের টাকা প্রদানের কথা স্বীকার করেছেন। কক্সবাজার ভ্রমণকরা একজন ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, এক শতাংশ থেকে আমি দেড় লাখ টাকা তুলেছি। এরমধ্যে এক লাখ টাকা ভ্রমণের জন্য দিয়েছি। বাকি টাকার উন্নয়ন কাজ করবো। টাকা সমন্বয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, মাটির কাজ তো, সমন্বয় করে নেব। আরেক চেয়ারম্যান বলেন, আমি কক্সবাজার যাইনি। পরিবার নিয়ে মেম্বাররা গেছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা চাপ দিয়ে আমার কাছে ওই ফান্ডের এক লাখ টাকা নেয়। একই মন্তব্য করলেন আরেক ইউপি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, কক্সবাজার যাইনি। তারপরও আমাকে এক শতাংশের এক লাখ টাকা দিতে হয়েছে। উপজেলা পরিষদের অধীনে কাজ করতে হয়। টাকা না দিয়ে উপায় নেই। এভাবে ১৭টি ইউনিয়নের প্রত্যেক চেয়ারম্যানের কাছ থেকে এক শতাংশের টাকা নেয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনজন ইউপি সচিব বলেন, ২ লাখ টাকার চেক পাওয়া গেছে। সেটা ক্যাশ করে সেদিনই উপজেলায় দিয়ে আসা হয়েছে। কোনো প্রকল্প নেয়া হয়নি। এদিকে, ঘটনাটি উপজেলার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সচেতন নাগরিক মহল বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা যেখানে কৃচ্ছতা সাধনের কথা বলছেন, সেখানে সরকারি টাকায় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে প্রমোদ ভ্রমণ করা দুর্নীতির সামিল। অথচ স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর বা জমি রেজিষ্ট্রি করের এক শতাংশের প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনা রয়েছে। ২০০৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের জারি করা চিঠিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা ওই অর্থ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে আলোচনা করে ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ম্যাচিং ফান্ড হিসেবে ব্যবহার করবেন। সে নির্দেশনা অনুযায়ী বনভোজন বা প্রমোদ ভ্রমণের জন্য টাকা ব্যয়ের কোনো সুযোগ নেই। এ ফান্ডের টাকা ইউএনও এবং উপজেলা প্রকৌশলীর যৌথ স্বাক্ষরে চেক দেয়া হয়ে থাকে। গোবিন্দগঞ্জ নাগরিক কমিটির আহবায়ক মতিন মোল্লা বলেন, পাঁচদিনের এ ভ্রমণে যে এক শতাংশ টাকায় ব্যয় হয়েছে, সেটা স্থানীয়ভাবে আলোচনার ঝড় তুলেছে। সবার মধ্যে ক্ষোভ আছে। কিন্তু প্রভাবশালীদের কারণে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। তিনি আরো বলেন, জনপ্রতি ১৫ হাজার লাগলে ৩০০ জনে ৪০ লাখ টাকা লাগার কথা। ভ্রমনের দিন সকালেই শতকরা ৮০ ভাগ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। এর প্রমাণ পাওয়া খুবই সহজ। ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখলেই বোঝা যাবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আরিফ হোসেন মুঠোফোনে সাংবাদিকদের কাছে কক্সবাজার ভ্রমণের কথা স্বীকার করেন। কার টাকায় কক্সবাজার গেছেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সবাই তার নিজ টাকা দিয়ে গেছেন। স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর বা জমি রেজিষ্ট্রি করের এক শতাংশের টাকা দিয়ে ভ্রমণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরণের কোন তথ্য আমার কাছে নেই। আমরা তাদের বরাদ্দ দিয়ে দেই। তারা কাজ করবে, আমরা কাজ দেখবো। তারা নিজের টাকায় না কোন টাকায় পিকনিকে গেছে, সেখানে আমার কিছু বলার নেই। এরআগেও চেয়ারম্যানরা পিকনিকে গেছেন। ইউএনও বলেন, এক শতাংশের টাকায় গ্রাম পুলিশদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়। এ ভাতা দেওয়ার পর যা থাকে, তা প্রতি মাসেই ইউপি চেয়ারম্যানদের দেয়া হয়ে থাকে। তাদেরকে ইউনিয়ন পরিষদের কর্মচারীর বেতন-ভাতা ও প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য টাকা দেয়া হয়েছে। তারা কি করবে, সেটা তারাই জবাব দিবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে না পরে টাকা দেয়ার নিয়ম, জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুইটি হয়, তবে বিষয়টি উপজেলা প্রকৌশল বিভাগ দেখে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রকৌশলী আতিকুর রহমান মুঠোফোনে সাংবাদিকদের বলেন, এটা ইউনিয়ন পরিষদের টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে দেয়া হয়ে থাকে। প্রকল্প বাস্তবায়িত না হলে সেটা আমাদের দেখার দায়িত্ব না। সেটা দেখবেন জেলা প্রশাসক ও ইউএনও।