আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ। ঢাকা জেলার একটি স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে নিরপত্তা প্রহরীর চাকরি নেন। সেই চাকরির সুবাদে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে পারেন। এসব কার্যক্রম রপ্ত করে ছয় বছর থেকে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের প্রতারণা করে আসছেন। সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা পরিচয়ে হুমকি দেওয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব।
নাহিদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে বৃহস্পতিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে নাহিদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, ‘২৫ জানুয়ারি রাতে সুনামগঞ্জ জেলার সদর থানাধীন নারায়নতলা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোকসেদ আলীর বাড়ি ও তার আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে অভিযান চালায় ভুয়া গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। অভিযানের নামে তারা বেশ কয়েকটি বাড়িতে লুটপাট চালায়।
ওই ঘটনায় একজন ভুক্তভোগী বাদী হয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলার দুই দিন পর ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার এজাহারনামীয় আসামি বিজন রায়কে মিরপুর মডেল থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃত বিজনের মাধ্যমে র্যাব আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদের নাম জানতে পারে। নাহিদ সুনামগঞ্জের ওই বাড়িগুলোসহ বিভিন্ন সময় দেশের নানা এলাকায় গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মিথ্যা পরিচয় দিয়ে লুটপাট এবং চাঁদাবাজির মূল পরিকল্পনাকারী। ওই তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব ডলার নাহিদকে খুঁজতে নজরদারি বাড়ায়।
পরে বিজনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব গতরাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে নাহিদকে গ্রেফতার করে। এ সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভুয়া পরিচয়পত্র এবং প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরিহিত ছবি উদ্ধার করা হয়।
কমান্ডার আল মঈন জানান, গ্রেফতারকৃত আব্দুল কুদ্দুস ওরফে ডলার নাহিদ বিভিন্ন সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে মানুষের কাছে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে মিথ্যা পরিচয় প্রদান করতেন। তিনি কোনোমতে প্রাথমিক শিক্ষার গন্ডি পেরোন। ২০০৯ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা থাকলেও নিজেকে ১৯৯৬ সালের এসএসসি ব্যাচ দাবি করেন। বিভিন্ন কৌশলে ওই ব্যাচের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গ্রুপে যুক্ত হয়ে নিজেকে গোয়েন্দা শাখা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় প্রদানের মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির টাকা, জমি ও ফ্ল্যাট উদ্ধারের নামে প্রতারণা করতেন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, নাহিদ নিজেকে গোয়েন্দা শাখা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে নিজেকে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়ি হতে তল্লাশির সময় নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করতেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার মাধ্যমে কৌশলে প্রশাসনের সহায়তা নিতেন। প্রতারণার কৌশল হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিতদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভুক্তভোগী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়ে তাদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে প্রতারণার করতেন।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ৪/৫ মাস আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি গ্রুপের মাধ্যমে বিজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে রাজধানীতে বিভিন্ন সময় পূর্বে গ্রেফতারকৃত বিজনের সঙ্গে ৭/৮ বার সাক্ষাৎ করে। এছাড়াও বিজনের বাড়ি সুনামগঞ্জে হওয়ায় সুনামগঞ্জ যান নাহিদ। বিজন সুনামগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তদের সঙ্গে তার সু-সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে বিজনের সঙ্গে সুনামগঞ্জে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে কৌশলে নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় প্রদান করে।
অতঃপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান যে এখানে তিনি মাদকের একটি চালানের বিরুদ্ধে অভিযান করতে এসেছেন এবং অভিযানের জন্য তাদের সহায়তা কামনা করেন। এসময় পূর্বে গ্রেফতারকৃত বিজন ও অন্যান্য সহযোগীদের সমন্বয়ে সুনামগঞ্জ জেলার সদর থানাধীন নারায়নতলা এলাকায় বিভিন্ন বাড়িতে লুটের জন্য পরিকল্পনা করে। প্রথমত তারা লুটের উদ্দেশ্যে ওই এলাকায় বিত্তশালী কয়েকটি বাড়ি টার্গেট করে। তিন দিন ধরে টার্গেটকৃত বাড়ি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ও বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করে। পরবর্তীতে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ঘটনাস্থলে যান নাহিদ। পরবর্তীতে স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা জানিয়ে তাদের ঘটনাস্থলে আসতে বলেন। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক নিজেকে গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোকসেদ আলী বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে তল্লাশি চালায়।
তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করে নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী হাতিয়ে নেয় তারা।
ঘটনাটি জানাজানি হলে অভিযান শেষ করে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগের চেষ্টা করে তারা। একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন তাদের আটক করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সংবাদ দেয়।
এসময় নিজেকে গোয়েন্দা শাখার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যান নাহিদ। গত ৫/৬ বছর ধরে ঢাকা ও পাবনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গোয়েন্দা সংস্থার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে অভিযানের নামে বিভিন্ন বাড়ি হতে নগদ অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করেছে নাহিদ ও তার সহযোগীরা।