রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরুর কথা আগামী বছরের ডিসেম্বরে। সার্বিকভাবে প্রকল্পটির অগ্রগতি ৫৩ শতাংশ। কয়েক দফায় উৎপাদন শুরুর সময়সীমা পেছানোর পর এখন তা আগামী বছরের ডিসেম্বরে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু ঐ সময়ে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট নির্মাণ সম্পন্ন হলেও নির্ধারিত সময়ে উৎপাদন শুরু নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সঞ্চালন ব্যবস্থা তৈরিতে পিছিয়ে থাকার কারণে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে এখন পর্যন্ত নির্মিত সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা এবং রামপাল কেন্দ্রের মতো একই ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে রূপপুর। নির্ধারিত সময়ে সঞ্চালন লাইন তৈরি না হলে অলস পড়ে থেকে আর্থিক ক্ষতি গুনতে হতে পারে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রূপপুর কেন্দ্রকেও। রূপপুর কেন্দ্রের দুটি ইউনিটের প্রতিটির উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। কেন্দ্রটির মাত্র ৪০ শতাংশ সঞ্চালন লাইন নির্মিত হয়েছে। বাকি কাজ আগামী এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন করা প্রায় অসম্ভব। পাবনার রূপপুরে ১ হাজার ৬২ একর জমিতে নির্মাণকাজ চলছে দেশের প্রথম ও একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরমাণু শক্তি কমিশনের তত্ত্বাবধানে রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। সূচি অনুযায়ী, এর প্রথম ইউনিটটির নির্মাণ কাজ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০২৪ সালের প্রথম ভাগে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আর্থিক বিবেচনায় এটি দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। সিংহভাগ খরচ (৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি) রাশিয়া সরকারের ঋণসহায়তা থেকে নির্বাহ করা হচ্ছে। এটির নির্মাণ ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রোসাটম এবং এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মনটরিং কার্যক্রমের সভা নিয়মিত হলেও সঞ্চালন লাইন নির্মাণ নিয়ে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এক সঙ্গে বৈঠক করেছে গত বুধবার। বৈঠকে কিছু বিষয়ে অনতিবিলম্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কাজ শুরুর বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, সঞ্চালন লাইনের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে সমন্বিতভাবে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং আমদানিসহ অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ গ্রাহক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সাব স্টেশন এবং সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে। পাশাপাশি কিছু জটিলতার জন্য যন্ত্রপাতি আমদানিও থেমে রয়েছে। আর ঐ যন্ত্রপাতি ছাড়া সঞ্চালন ব্যবস্থা প্রস্তুত করা যাবে না।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক এখন শীতল। রূপপুর কেন্দ্রটি রাশিয়ান কোম্পানি নির্মাণ করলেও এর বিদ্যুৎ সঞ্চালনের উপকেন্দ্র (সাব স্টেশন) নির্মাণকাজ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) জার্মানির প্রতিষ্ঠান সিমেন্স এবং ইইউর সঙ্গে নানা চুক্তিতে আবদ্ধ সুইজারল্যান্ডের এবিবি। প্রতিষ্ঠান দুটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগেই সাব স্টেশন নির্মাণের কাজ কিছুটা শেষ করেছে। কিন্তু যুদ্ধের পর ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার শীতল সম্পর্কের জেরে কাজ এগিয়ে যাচ্ছে না। নির্মাণাধীন সাব স্টেশনের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তারা। ঐ কর্মকর্তা জানান, রাশিয়ার স্পন্সরে বা তত্ত্বাবধানে চলা কোনো প্রকল্পে যন্ত্রাংশ সরবরাহ না করার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করতে পারছে না সিমেন্স ও এবিবি। যুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেনের পক্ষ নিলে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয় রাশিয়া। বিপরীতে ইউরোপের দেশগুলো সম্মিলিতভাবে রাশিয়াকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। দুই পক্ষের এ সংকটের মাঝখানে পড়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাংলাদেশও।
এদিকে সঞ্চালন লাইনের নানা যন্ত্রপাতি আমদানি করতেও ঋণপত্র খুলতে পারছে না সরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি)। দুই মাসে ব্যাংকগুলোতে ঋণপত্র খুলতে ব্যর্থ হয়েছে তারা। ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলছে না ব্যাংকগুলো। অবশেষে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চেয়ে গত সপ্তাহে চিঠি দিয়েছে কোম্পানিটি। অর্থ বিভাগে দেওয়া বিদ্যুৎ বিভাগের এক চিঠিতে জানানো হয়, বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলার জন্য দুই মাস ধরে পিজিসিবি বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদন করেছে। কিন্তু কোনো ব্যাংকই ৫ হাজার ২৪০ কোটি টাকার এ ঋণপত্র খুলতে রাজি হয়নি।