‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখীর ঝড়, তোরা সব জয়ধ্বনি কর’- কাজী নজরুল ইসলামের অমর কবিতার মতোই জয়ধ্বনি করে ফেললো বাংলাদেশ। ইতিহাসের অমর পাতায় অক্ষয় কালিতে নিজেদের নাম লিখে ফেললো তামিম ইকবালের দল। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ৯ উইকেটে জিতে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ।
তাসকিন আহমেদের আগুনঝরা বোলিংয়ে প্রোটিয়াদের মাত্র ১৫৪ রানে আটকে দেয় বাংলাদেশ। এরপর তামিমের অধিনায়কোচিত ৮৭ রানের ইনিংসে ১৪১ বল হাতে রেখে জয় নিশ্চিত হয়ে যায়। যে জয় বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়।
বাংলাদেশের ক্রিকেট রূপকথায় যোগ হলো আরেকটি নতুন অধ্যায়। যে অধ্যায় বাংলাদেশকে ভাসাচ্ছে নিদারুণ আনন্দে। সেঞ্চুরিয়নের সবুজ গালিচায় বাংলাদেশও আনন্দে মাতলো। ড্রেসিংরুম থেকে ওয়েটিং লাউঞ্জ; মিরাজ, ইয়াসির, আফিফদের বাধনহারা উল্লাস, আনন্দ নৃত্য মনে করিয়ে এশিয়ার দল হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশনে সিরিজ জয়ের আনন্দ কতোখানি। যেই কাজটা এখনও পারেনি ১৯৯৬ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়নরা।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই দলটাই গত জানুয়ারিতে ভারতকে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করেছিল। মাসখানেকের ব্যবধানে বাংলাদেশের সামনে দাঁড়াতেই পারল না বাভুমা, মিলার, ডুসেনরা! দক্ষিণ আফ্রিকায় বাঘের গর্জন শুনেই শেষ স্বাগতিকরা।
দূরদেশ দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার আগে একটি জয়ের কথা বলে গিয়েছিলেন তামিম। সাকিবও বলেছিলেন, একটি জয়ই হতে পারে বড় অর্জন। কিন্তু এই দলটা একটি জয়ে যে তৃপ্ত নয় তা বুঝিয়ে দিলো সিরিজ নির্ধারণী ফাইনাল ম্যাচে। স্রেফ স্বাগতিকদের উড়িয়ে বাংলাদেশ বিজয়ের ঝাণ্ডা উড়ালো।
সেঞ্চুরিয়নে টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই ওপেনার ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। ডি কক ও জান্নেমান মালানের বাউন্ডারির ফুলঝুরিতে ৬ ওভারেই রান পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই। এরপর বোলিংয়ে অভাবিত বাঁক বদল। যার নেতৃত্বে ছিলেন পরিশ্রমী, অধ্যবসয়ী এক পেসার, তাসকিন আহমেদ। মিরাজ শুরুতে পথের কাটা ডি কিককে বিদায় করেন।
এরপর তাসকিনের পথ চলা শুরু। প্রথম দুই স্পেলে তার বোলিং ফিগার ৫-০-১৭-২। ভয়ংকর মালানকে ক্রস সিমে উইকেটের পেছনে তালুবন্দি করানোর আগে কাইল ভেরিয়েন্নকে বোল্ড করেন। এরপর কয়েক ওভার বিরতি। কিন্তু ফিরেই ডানহাতি পেসার রূদ্ররূপে। ডোয়াইন প্রিটোরিয়াসকে আউট করার পর একই ওভারে তার শিকার ডেভিড মিলার ও কাগিসু রাবাদা। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ২০১২ সালের পর সফরকারী দলের পেসার পেলেন ৫ উইকেট। সবশেষ এমন কীর্তি গড়েছিলেন শ্রীলঙ্কার হয়ে লাসিথ মালিঙ্গা।
তাসকিনের জন্য এই অপেক্ষাটা আরও লম্বা। মিরপুর শের-ই-বাংলায় ২০১৪ সালে অভিষেকে ৫ উইকেট পেয়েছিলেন তাসকিন। দ্বিতীয় ৫ উইকেটের জন্য ডানহাতি পেসারের অপেক্ষা করতে হলো ৮ বছর। অবশ্য এই কয়েক বছরে কত ঝড়-ঝাপ্টা গেছে তার ওপর দিয়ে। ইনজুরি, বোলিং অ্যাকশন সমস্যা, ফর্মহীনতা, দল থেকে বাদ পড়া; খেলায় অমনযোগী… কত কিছু হয়ে গেল তার জীবনে! সেই সমস্ত কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে তাসকিন এখন শুধু বিশ্বমানের পেসারই নন, বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের নায়ক।
তাসকিনের ৫, সাকিবের ২, মিরাজ ও শরিফুলের ১টি করে উইকেটে বোলাররা লক্ষ্য নাগালেই রেখে দিয়েছিলেন। ৪৬ রানে প্রথম ব্রেক থ্রুর পর ১৫৪ রানে অলআউট করার পুরো কৃতিত্বটা তামিম ম্যাচ শেষে গোটা দলকেই দিয়েছেন।
বোলিংয়ে যেমন আগ্রাসন ছিল, ব্যাটিং ছিল ঠিক ততোটাই দাপট। অধিনায়ক তামিম নিজেকে মেলে ধরেন বাউন্ডারির ফুলঝুরি ছুটিয়ে। কাগিসো রাবাদা, লুঙ্গি এনগিডি, প্রিটোরিয়াসদের এক মুহূর্তের জন্য ২২ গজে থিতু হতে দেননি। অফ সাইডে বরাবরই সাবলীল তামিম। কিন্তু আজ অনসাইডে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান নিজের জড়তা কাটিয়ে হাত খুলে রান করেছেন। রাবাদাকে পুল করে মিড উইকেট দিয়ে যে দুটি চার মেরেছেন তা মুগ্ধতা ছড়িয়েছে।
লিটনও বসে থাকেননি। নিজের দারুণ ফর্ম, সামর্থ্য মেলে ধরেছেন আরও একবার। দুজনের ১২৭ রানের জুটি বাংলাদেশকে জয়ের খুব কাছাকাছি নিয়ে যায় এবং স্বাগতিকদের ম্যাচ থেকে ছিটকে দেয় অনায়াসে। জয়ের খুব কাছে গিয়ে লিটন ৪৮ রানে ফিরে আসেন কেশভ মাহারাজের বলে। এরপর সাকিব ক্রিজে এসে জয়টাকে আরও সহজ করে তোলেন।
এই জয়, এই বীরত্বগাথার স্বপ্নডানায় ভর করবে তাসকিন ও তামিমরা। নিয়ে যাবে অনেক দূর। হয়তো দৃষ্টিসীমার বাইরে। এমন ম্যাচ, এমন জয় শুধু বাংলাদেশের সমর্থকদের নয়, দুনিয়ার সব ক্রিকেট সমর্থকেরও।