বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সাবেক সিএসও (চিফ সিকিউরিটি অফিসার) রাশিদা সুলতানার বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে বেবিচক। গঠন করা হয়েছে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি।
প্রভাব খাটানো, শৃঙ্খলাপরিপন্থি কর্মকাণ্ড, অধস্তনদের হুমকি-ধমকি, গালাগাল ও ঘুস বাণিজ্যসহ ৫টি গুরুতর অভিযোগের তদন্ত করবে এ কমিটি। গত ১২ জুন ৩ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলা হয়েছে।
জানা গেছে, উপপরিচালক রাশিদা সুলতানার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো হচ্ছে-সহকারী পরিচালক (এটিএম) ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক সুপ্লব কুমার ঘোষকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল, ধর্মীয় দিক থেকে কটাক্ষ করা এবং শারীরিকভাবে আঘাতের হুমকি।
গত ২০২০-২১ ও ২০২২ সালের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসআর) যথাসময়ে জমা না করার বিষয়ে ব্যাখ্যা তলবের জবাব দেননি। বেবিচকের সাবেক সদস্য (নিরাপত্তা) আবু সালেহ মাহমুদ মান্নাফী কর্মরত থাকার সময় বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিদাকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মেডিকেল বোর্ডের কাছে উপস্থিত হতে বলা হলেও সেটি তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
মোটর পরিবহণ চালক কাওসার আলী অ্যাভসেক বিভাগে কর্মরত থাকাবস্থায় তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও অশোভন আচরণ করেন। এছাড়া সৈয়দপুর বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপকের কাছে ঘুস দাবি করলে সেটি না দেওয়ায় তাকে গালাগাল, লাঞ্ছিত করাসহ চাকরি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি অন্যতম।
এছাড়া দুটি সরকারি বাড়ি এবং একাধিক গাড়ি নিজের দখল করে রেখেছেন। প্রসঙ্গত, বর্তমানে রাশিদা সুলতানা ট্রেনিং অ্যান্ড সার্টিফিকেশন বিভাগের উপপরিচালক হিসাবে কর্মরত আছেন।
বেবিচক সদস্য (এটিএম) এয়ার কমোডর একেএম জিয়াউল হককে এই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন পরিচালক (সিএনএস) মাহাবুবুর রহমান, উপপরিচালক (পার্সোনাল) সোহেল কামরুজ্জামান।
সহকারী পরিচালক (মানবসম্পদ উন্নয়ন) নিজাম উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক চিঠি থেকে এই তথ্য জানা গেছে। এর আগেও গত ২৬ মে রাশিদা সুলতানার বিরুদ্ধে অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই চিঠিতে ২৬ মে পরিচালক (প্রশাসন)-এর সভাপতিত্বে গঠিত তদন্ত কমিটিকে বর্ণিত তদন্ত থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয়।
রাশিদার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ আইনানুগ শাস্তি প্রদানের জন্য গত বছরের ১২ জুন সাবেক সদস্য (নিরাপত্তা) আবু সালেহ মান্নাফি একটি চিঠি দেন বেবিচক চেয়ারম্যানের কাছে। ৭ পৃষ্ঠার ওই চিঠিতেও রাশিদার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ আছে।
এর মধ্যে অফিসিয়াল শৃঙ্খলাপরিপন্থি কর্মকাণ্ড, প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হুমকি প্রদানের অভিযোগ আছে। তিনি বিমানবন্দরে ভিভিআইপি নিরাপত্তা পালনের সময়ে এসএসএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও ভিআইপি নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন।
এসএসএফ এ বিষয়ে অভিযোগ দিলে বেবিচকের প্রশাসন বিভাগের তদন্তে তা প্রমাণিত হয়। রাশিদা সুলতানা এক বছরের বেশি সময় ধরে কাওলার আবাসিক এলাকায় সি-২/১ ও সি-২/৩ দুটি বাসা দখল করে রাখেন। এ বিষয়ে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হলেও তিনি কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করে বাসা দুটি নিজের দখলে রাখেন।
এছাড়া রাশিদার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি একটি ফাইল আটকে রেখে একটি এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা নিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী বহির্গামী কার্গোগুলোর স্ক্যানিং বাবদ সংশ্লিষ্ট এযারলাইন্সের কাছ থেকে কেজিপ্রতি ২ সেন্ট আদায় করতে হয়।
সিভিল এভিয়েশন হিসাব শাখা থেকে পাক্ষিক বিল আকারে এয়ারলাইন্সের কাছে দিলে তারা ১৫ দিনের মধ্যে সে বিল পরিশোধ করে। অভিযোগ আছে একটি এয়ারলাইন্সের কাছে এ ধরনের ৮১৬০ মার্কিন ডলার বকেয়া ছিল।
এই অভিযোগের ভিত্তিতে ওই এয়ারলাইন্সের কাছে ৭ দিনের মধ্যে ওই বকেয়া পরিশোধের জন্য চিঠি দেওয়া হয়। অন্যথা তাদের স্ক্যানিং সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু রাশিদা সুলতানা নিরাপত্তা বিভাগের সহকারী পরিচালক থাকার সময়ে এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ওই ফাইলটি নিজের কাছে আটকে রাখেন। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের অবৈধ আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেন।
বারবার বলার পরও দীর্ঘ এক মাস ফাইলটি নিজের কাছে আটকে রাখেন। বাধ্য হয়ে রাশিদা সুলতানাকে বাদ দিয়ে হিসাব শাখার মাধ্যমে ওই টাকা আদায় করা হয়। হিসাব শাখা অপর একটি চিঠির মাধ্যমে নিরাপত্তা শাখাকে উপেক্ষা করে ওই টাকা আদায় করেন।
একটি সংস্থার এক গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিদা সুলতানা বিভিন্ন বিমানবন্দর ব্যবস্থাপকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত কর্মকর্তাদের সরকারবিরোধী হিসাবে উল্লেখ করে ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন।
তিনি বিদেশ প্রশিক্ষণ ও ফ্যাক্টরি একসেপটেন্স টেস্টে বিদেশ ভ্রমণের সময় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিজনেস ক্লাসের টিকিট, দৈনিক ভাতার জন্য অতিরিক্ত অর্থ আদায়সহ চিকিৎসার নামে বাড়তি অর্থ আদায় করে থাকেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাশিদা সুলতানা বলেন, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আগামী মাসে তার প্রমোশন হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রমোশন আটকে দেওয়ার জন্য বেবিচকের একটি সিন্ডিকেট এসব মিথ্যা অভিযোগ দাঁড় করিয়েছে। তিনি বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে বেবিচকে যোগদান করি। যোগদানের পর থেকে আমাকে নানাভাবে অপদস্থ করা হয়েছে। ভালো কোনো পোস্টিং দেওয়া হয়নি। সাবেক সদস্য নিরাপত্তা আবু সালেহ মান্নাফী স্যার আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছেন। তিনি আমাকে কোনোভাবে মেডিকেল বোর্ডের কাছে দাঁড় করাতে পারেন না। এটা বেআইনি ছিল বলে আমি মেডিকেল বোর্ডের কাছে যাইনি। সৈয়দুপর বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপকের অভিযোগ মিথ্যা। এতদিন এসব নিয়ে কোনো আলোচনা ছিল না, যখনই আমি চেয়ারম্যান বরাবর প্রমোশনের জন্য আবেদন করেছি তখনই প্রশাসন বিভাগের একজন পরিচালকসহ আমার অধস্তনরা আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।