বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ‘রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচুরিটি’ শীর্ষক মাসিক সেন্ট্রাল সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোববার সকালে (১২ ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রী.) বিশ্ববিদ্যালয়ের এ-ব্লক অডিটোরিয়ামে এ সেমিনারের আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল সেমিনার সাব কমিটি। সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ। সেমিনারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউন্যাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সঞ্চয় কুমার দে ‘‘আরওপি : এ চ্যালেঞ্চ ফর ইনট্যাক্ট সারভাইভাল অফ প্রিটার্ম নিউবর্ন’’ ও চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী ‘‘ আরওপি : ব্লাইন্ডিং অব নিউন্যাটোস” শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সেন্ট্রাল সাব কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী। সেমিনারে বলা হয়, অপরিণত নবজাতক এবং যারা স্বল্প ওজনের নবজাতক, যাদের চোখে অন্ধত্ব বয়ে নিয়ে আসতে পারে এমন একটি রোগ মারাত্মক রোগ হল রেটিনোপ্যাথী অব প্রিম্যাচুরিটি সংক্ষেপে আরওপি । যখন নবজাতকরা মাতৃগর্ভে ৩৫ সপ্তাহের আগেই জন্মগ্রহণ এবং তাদের ওজন যখন ২০০০ গ্রামের বা ২ কেজির নিচে থাকে বিশেষ করে এদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যাদের নিউন্যাটোলজি বা এনআইসিইউতে ভর্তি করা হয় তখন এই রোগটি শিশুদের মাঝে দেখা যেতে পারে। এই রোগটির বিশেষ দিক হল, জন্মগ্রহণের সময় কোন নবজাতকই এ রোগে আক্রান্ত থাকে না। এমনকি জন্মগ্রহণের প্রথম ১৪ বা ১৫ দিনের মধ্যে এই রোগটি নবজাতকদের হয় না। যখন এই রোগটি ধরা পড়ে, সাথে সাথে চিকিৎসা না হলে; নবজাতকরা অন্ধ হয়ে যেতে পারে। ২০০০ গ্রামের নিচে বা ৩৫ সপ্তাহের আগে জন্মগ্রহণকারী নবজাতকদেরকে ৩০ দিনের ভিতর অনন্ত একবার চক্ষু পরীক্ষা করতে হবে। বলে রাখা ভালো,যারা এই নবজাতকের চেয়েও অপরিণত ও অল্প ওজনের বা ২৮ সপ্তাহের আগে হয়েছে এবং ১২০০ গ্রামের নিচে হয়েছে; তাদের ক্ষেত্রে এই স্ক্রিনিংয়ের সময়টি নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ এদের ক্ষেত্রে আরও আগেই যদি রোগটি চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে তারা খুব শীঘ্রই অন্ধত্বের দিকে যেতে পারে। সমগ্র বাংলাদেশে অপরিণত শিশুদের ক্ষেত্রে কতভাগ শিশু আরওপির কারণে অন্ধ হয়েছে, দুঃখজনকভাবে সেই জরিপ কখনো করা হয়নি। কারণ এই বিষয়ে তেমন কোন সচেতনতা নাই। এজন্য কোন ধরণের ডকুমেন্টশন করা হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় এই আরওপি অপরিণত এবং স্বল্প ওজনের নবজাতকের ভিতর ২৩.৭ শতাংশ আরওপি রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে এদের সবারই যে চিকিৎসা লাগবে এমন নয়। অনেকের ক্ষেত্রেই আরওপি ক্লিনিকে ভাল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু যাদের ক্ষেত্রে আরওপি ক্লিনিকেও ভাল হবে না, সেই নবজাতকরা অন্ধ হয়ে যায়, সেই অন্ধত্ব অনিবারণ যোগ্য। অর্থাৎ আরওপি রোগটি প্রতিরোধ যোগ্য। কিন্তু এ রোগে একবার অন্ধ হয়ে গেলে সেটি আর কোনো চিকিৎসায় ভাল হবে না। বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির সাথে সময়ের আগে জন্ম নেয়া শিশুর সমস্যাও বাড়ছে। এক সময় অন্ধত্বের মূল কারণ ছিল ভিটামিন-এ এর অভাব। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের ফলে ভিটামিন-এ জনিত অন্ধত্বের সংখ্যা কমছে কিন্তু প্রিম্যাচুর বার্থ বাড়ার জন্য তাদের চোখের সমস্যাও বাড়ছে যা এখন শিশুদের অন্ধত্বের প্রধান কারণ। বাংলাদেশের বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায়, আরওপি ২০% থেকে ৩০% প্রিম্যাচুরড বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যেসব নবজাতক সময়ের আগে জন্ম নেয়, অতিরিক্ত অক্সিজেন পায়, সংক্রমণে ভোগে, মেকানিক্যাল ভেন্টিলেশন সেবা পায়, যাদের বার বার রক্ত সঞ্চালন করা হয়, তারা ঝুঁকিতে থাকে। সংক্রমণে ভোগে যারা অনেক দিন অক্সিজেন পান তারাও ঝুঁকিতে থাকে। আরওপি স্ক্রিনিং একটি পরীক্ষার যার মাধ্যমে কম বয়সে আরওপি নির্ণয় করা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নবজাতক বিভাগ ২০১৩ সাল থেকে চক্ষু বিভাগের সাথে আরওপি স্ক্রিনিং এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত চক্ষু চিকিৎসক যারা এ ধরনের চিকিৎসা করে তার স্বল্পতা আছে। আমাদের দেশে আরওপি চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাগুলো হলো, সচেতনতার অভাব, রেফারেলের অভাব, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বড় শহর কেন্দ্রীক এ চিকিৎসাসেবা সীমাবদ্ধ থাকা। এই বিষয়গুলোকে সমাধান করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরওপি ক্লিনিকের চিকিৎসকরা সচেষ্ট আছেন। সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এক্ষেত্রে পেশাজীবি সংগঠন, উন্নয়ন সহযোগী সংগঠন, সামাজিক সংগঠন ভূমিকা রাখতে পারে। প্রধান অতিথির বক্তব্যে মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, আরওপি বিষয়টি অনেকের কাছে নতুন। নবজাতকদের যখনই অক্সিজেন বেশী দেয়া হয় তখনই এটি বেশী হয়। আজকাল কিছু সিজারিয়ান সেকশন সময়ের আগে করা হয়, এর মধ্যে টেস্ট টিউব বেবির সময় মা ও শিশুর সুস্থতার জন্য আরলি সিজারিয়ান সেকশন করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এসব নবজাতকদের মধ্যে অনেক শিশু আরওপি রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আরওপি সেন্টার প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত ৫৯৬ জন রোগী এসেছে। যার মধ্যে ২৩.৭ শতাংশ রোগীর আরপি রোগ পাওয়া গেছে। আগে দেশে ৩০ হাজার শিশু রাতকানা রোগে আক্রান্ত হতো । কিন্তু সরকারের উদ্যোগের ফলে এটি কমে ১০ হাজারে নেমে এসেছে। আরওপি ও অন্যান্য চোখের সমস্যার কারণে দেশে ৪০ হাজার শিশু রোগী অন্ধত্ব বরণ করছে। মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, বাংলাদেশে রেটিনা বিশেষজ্ঞ অনেক কম। বাংলাদেশে ১৪০০ জন চক্ষু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মধ্যে মাত্র ১২০জন রেটিনা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ১৬ কোটি মানুষের মাঝে এত কম সংখ্যক রেটিনা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্বারা আরওপি স্ক্রিনিং করা সম্ভব নয়। সারাদেশের ভিশন সেন্টারের মাধ্যমে আরওপি রোগীদের রেটিনা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো যেতে পারে। প্রান্তিক পর্যায়ে আরওপি স্ক্রিনিং করার জন্য কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, নবজাতক, মা ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করতে হবে। দুই মাসের মধ্যে শিশুদের চক্ষু স্ক্রিনিং করাই ভাল না হলে এই শিশুরা যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তারা দেশের বার্ডেন হয়ে থাকবে।