ভেতরের রংমহল যেভাবে সেজেছিল, বাইরে তার আয়োজন ছিল দ্বিগুণ। আহমেদাবাদের এত আলো যে ম্যাচ শেষের আগেই নিভে যাবে সেটা কেই বা ভেবেছিলেন। ভারতকে বিশ্বকাপ জেতাতে যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রার্থনায় বসেছিলেন। এক লাখ ৩২ হাজার দর্শকের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক মিলে দেড় লাখের বেশি ভারতবাসী ঘিরে থাকা নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম থেকে ১১ জনের অস্ট্রেলিয়া যে বিশ্বকাপ ছিনিয়ে নেবে, এটা তো কল্পনাতেই মানায়।
১১ জন বললে ভুল হবে, এক ট্রাভিস হেডই তো রোহিত-কোহলিদের কান্নায় ভাসালেন। যার নাম ফাইনালের আগে কেউই বলেননি! আবেগের নীল স্রোত থমকে গেল নিমিষেই। আসমুদ্র হিমাচলকে যা গ্রাস করেছিল, তা রাতের মায়ায় মোহ ভঙ্গ হলো। গোটা ভারতে তখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। নিমিষেই পরিণত হলো শোকের দেশে। ম্যাচ বুঝে অনেক আগেই স্টেডিয়াম থেকে বের হতে শুরু করেছিলেন দর্শকরা কিন্তু রোহিতরা যাবেন কোথায়। মোহাম্মদ সিরাজের বলে পুল করে ডাবল নিলেন ম্যাক্সওয়েল।
শেষ আঁচড় দিলেন! ড্রেসিংরুম থেকে অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যানেজমেন্টসহ বাকি খেলোয়াড়রা ধেয়ে আসছেন, মাটিতে লজ্জা-হতাশায় নুয়ে পড়লেন লোকেশ রাহুলরা। চোখের সামনে দেখতে হলো প্যাট কামিন্সদের বুনো উল্লাস।
বিশ্বকাপ জয়ের মধুর স্বপ্ন যে আলো ছড়িয়ে রেখেছিল, রবিবাসরীয় ফাইনাল সেখানে দেখাল ‘নীল’ কতটা বেদনার। ২৪১ রানের লক্ষ্যে হেডের দুর্দান্ত ইনিংসের (১২৯) সামনে অতি মামুলি হয়ে গেল। ৪২ বল হাতে রেখে ছয় উইকেটের জয়ে ‘ষষ্ঠ মিশন’ সফল করল অস্ট্রেলিয়া। ১২ বছরের ভারতের মুম্বাই ফিরল না আহমেদাবাদে!
২০ বছরের জোহানেসবার্গ যন্ত্রণা অস্ট্রেলিয়া আবার ভারতকে ফিরিয়ে দিল নিজেদের মাঠেই। ম্যাচ শেষে রোহিতের নাকি বিরাট কোহলির মুখটা বেশি নীল হয়ে গেল সেটা ঝলমলে আলোয় বোঝা গেল না। সদ্য দীপাবলির আনন্দভোগ করা কোহলি এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন যে, বিরাট মঞ্চে আতশবাজি কিংবা লেজার শোয়ের দশরঙা আলোও এত চক্ষু যন্ত্রণার হয়। ম্যাচের শুরু থেকে শোনা যাচ্ছিল সেই শঙ্খধ্বনি। কিন্তু কান পেতে থেকেও সেটা শেষ বেলায় আর কানে এলো না। নিরাপত্তার ঘেরাটোপটাকে বড়ই অরক্ষিত লাগছিল রোহিতের কাছে। এভাবেই ঘিরে রেখেও ট্রফি আটকানো গেল না!
ফিল হিউজ নিশ্চয়ই স্বর্গে বসে হাসছিলেন, হাততালি দিচ্ছিলেন। মিচেল স্টার্ক ও স্টিভেন স্মিথের হাতে ছিল কালো বাহুবন্ধনী। দলের অন্য কারও হাতে এমনটা ছিল না। দুজনের হাতে দুটি শব্দে ছিল ‘পি’ এবং ‘এইচ’!
তার অর্থ ফিল হিউজ। লড়াই ও উৎসবের বিশ্বকাপ ফাইনালে হঠাৎ শোকসূচক কালো বাহুবন্ধনীই যেন শক্তি জুগিয়ে গেল অস্ট্রেলিয়াকে। কামিন্স শুরুতে ফিল্ডিং নিয়ে ভড়কে দিয়েছিলেন রোহিতকে। নীল জার্সির সমুদ্রের মধ্যে থেকে বিরাট সাহসী সিদ্ধান্ত। গর্জন কীভাবে ফিরিয়ে দিতে হয় সেটা ব্যাটে-বলেই প্রমাণ করলেন।
ফ্লাডলাইটে নতুন বলে জাসপ্রিত বুমরা ও মোহাম্মদ শামি আঘাত করেছেন তিনবার। সেটাও ৪৭ রানের মধ্যে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া দমেনি। হেড ও লাবুশেন গড়েছেন দুর্দান্ত এক জুটি। পালটা আক্রমণে আর ছন্দময় ব্যাটিংয়ে আলোচনার বাইরে থাকা নামটাই ফাইনালের ‘হেড’ হয়ে রইল। হেড যখন ফিরেছেন, অসিদের জয় তখন অনেকটাই নিশ্চিত। মাত্র দুই রান দূরে। হেড ১২০ বলে করেছেন ১৩৭ রান। লাবুশেন সঙ্গ দিয়ে ১১২ বলে করেন ৫৮*।
টস জিতে যখন বোলিং নেয় অস্ট্রেলিয়া, তখন দারুণ খুশি ছিল ভারতীয় শিবির। এই মাঠে লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করে ভালো কিছু করা গেলেও দলটি যে ভারত। তারা ইদানীং চারশর কাছে না গিয়েই তো থামে না! ম্যাচের দশ ওভারের সময় ভারতের রান ৭৬! গ্লান ম্যাক্সওয়েলকে একটা ছয় ও চার মেরেছেন রোহিত। পরের বলে আবারও ছয়ের চেষ্টা উপরে উঠে যাওয়া বলটার পেছনে গুলির বেগে ছুটে সামনে অনেকটা ঝাঁপিয়ে দারুণ দক্ষতায় মুঠোবন্দি করলেন হেড। এরপর ধপাস করে মাটিতে পড়লেও বল হাতছাড়া করেননি তিনি।
ধারাভাষ্যকক্ষে ইয়ান স্মিথ বললেন, ‘ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে এটিই।’ এই কথাটাই প্রেসবক্সে সবাই একে অন্যকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। ভারতীয় কয়েকজন সাংবাদিক মুচকি হাসলেন। রোহিত শর্মা গেছে তো কি হয়েছে, পুরো ব্যাটিং লাইনআপই তো বাকি! পুরো টুর্নামেন্টে খুনে মেজাজে ব্যাটিং করে দলকে সেট করে দিয়ে যাচ্ছেন রোহিত। এদিনও তাই করলেন! অথচ, স্মিথের সেই উক্তি ইনিংসজুড়ে প্রতিফলিত হলো।
প্রবীণ এক সাংবাদিক মনে করিয়ে দিলেন ১৯৮৩ সালের কথা। অনেকটা একইভাবে ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ নিয়েছিলেন কপিল দেব। ভারতীয় অধিনায়কের সেই ক্যাচ স্মরণীয় হয়ে আছে এখনো। কাল ম্যাচে হেডের এই ক্যাচটি অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিংয়ের নমুনা মাত্র। ক্রিকেটে তিন বিভাগের এই একটা জায়গা দিয়েও যে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যায়, সেটা দেখাল অস্ট্রেলিয়া। ইনিংসজুড়েই অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং ছিল দুর্দান্ত, অবিশ্বাস্য। সেই স্মিথই শেষ বেলায় জানান, অন্তত ২৫ রান ফিল্ডিংয়ে বাঁচিয়েছে অস্ট্রেলিয়া।
ব্যাটিং-বোলিংয়ে অনেক সময় ক্রিকেটারদের অনেক কিছু করার থাকে না। কিন্তু ফিল্ডিংয়ের বিষয়টি থাকে সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে। সেই দায়িত্বটা অস্ট্রেলিয়া ছাড়তে চায় না কখনোই। আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান শ্রেয়াস আয়ারের উইকেটে যাওয়া-আসা, দুর্দান্ত ফিফটির পর লোকেশ রাহুলের আত্মাহুতিতে ফিল্ডারদের দোষ ছিল না।
বোলারদের যতটুকু অবদান ছিল তার বেশি নিজেদের ভুলেই আউট হয়েছেন। দলের সবচেয়ে ‘বুড়ো’ যিনি, সেই ডেভিড ওয়ার্নারই মাঠে সবচেয়ে ক্ষুরধার। চিতার গতিতে দৌড়, দুর্দান্ত রিফ্লেক্স, ডাইভিংয়ে নিখুঁত টাইমিং। বাকিরা যা দেখে আরও বেশি অনুপ্রাণিত। কোহলি-রাহুলরা তাই গ্যাপই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তবে পুরো টুর্নামেন্টে যাদের মোটেই ব্যাটিংয়ে সেভাবে দায়িত্ব নিতে হয়নি, রবীন্দ্র জাদেজা ও সূর্যকুমার যাদব শেষ পরীক্ষায় নেমে ব্যর্থ হলেন।
বারবার আগেরদিনে কামিন্সের কথা মনে পড়তে লাগল সবার। এত দর্শককে স্তব্ধ কীভাবে করতে হয় সেটা ভালো জানি আমরা! যেই লক্ষ্য, সেই কাজ! এই মঞ্চেও হলো না ভারতের! অপেক্ষার পালা আরও দীর্ঘতর হলো। শুধুই হতাশার সাক্ষী হতে হলো স্বাগতিকদের।