একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন যাবত পলাতক যুদ্ধাপরাধী আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলীকে (৭০) রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৩। তিনি দীর্ঘদিন ধরে গাইবান্ধার তিস্তা নদীর নির্জন তীর বেলকার চরে আত্মগোপনে ছিলেন।
রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ এই তথ্য জানিয়েছেন।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, গতকাল রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন ধরে পলাতক আসামি আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলীকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়।
র্যাব জানায়, আসামি আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী ১৯৭১ সালে গঠিত ইসলামী ছাত্র সংঘের একজন অন্যতম সংগঠক এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানা জামায়াত ইসলামীর সক্রিয় সদস্য ছিল। এছাড়াও তিনি শান্তি কমিটির সক্রিয় সদস্য হিসেবে ওই এলাকায় লুটপাট ও বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম চালাতেন।
১৯৭১ সালের ৯ অক্টোবর পূর্ব শত্রুতার জের ধরে শান্তি কমিটির দুর্ধর্ষ ডাকাত মো. আব্দুর রহিম মিয়া এবং আসামি আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে আবু সালেহ, আব্দুল লতিফ, রুহুল আমিন, নাজমুলসহ আরও কয়েকজন কুখ্যাত রাজাকার এবং পাকিস্তানি আর্মিদের একটি দল নিয়ে সকাল সাড়ে আটটায় মালিবাড়ি গ্রামের গণেষ চন্দ্র বর্মনের বাড়িতে হামলা করে লুটপাট এবং বাড়ির সদস্যদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এরপর গণেষ চন্দ্র বর্মনকে উঠিয়ে নেওয়ার জন্য উদ্ধত হলে তার স্ত্রী, পুত্র, বন্ধু আকবর আলী এবং প্রতিবেশী মোহাম্মদ আলী ও মনসুর আলী এগিয়ে এলে তাদের সবাইকে ধৃত আসামি এবং তার সহযোগীরা তাদের বেধড়ক মারপিট করে এবং একপর্যায়ে তাদেরকে আটক করে নিকটবর্তী দরিয়াপুর ব্রিজে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গণেষ চন্দ্র বর্মনকে নিয়ে হাত-পা বেঁধে মুখমণ্ডল ও সারা শরীরে নৃশংসভাবে আঘাত করে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে।
এরপর তার মুখমণ্ডল বিকৃত করে দেয় এবং মৃতদেহের সাথে ইট ও পাথর বেঁধে এমনভাবে নদীতে ডুবিয়ে দেয়, যাতে করে লাশটি ভেসে ওঠতে না পারে। আটককৃত আকবর আলী, মোহাম্মদ আলী এবং মনসুর আলীকে তারা কামারজানি আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে মারধর করে এবং নির্যাতন করে। আকবর আলীকে তারা উপস্থিত অপর দুই ব্যক্তির সামনে বৈদ্যুতিক শক এবং নির্যাতনের মাধ্যমে ক্যাম্পেই হত্যা করে। পরের দিন বিকেলে অপর দুই ব্যক্তি মনসুর আলী এবং মোহাম্মদ আলীকে তারা ক্যাম্প থেকে ছেড়ে দেওয়ার পর কোনো রকম পালিয়ে জীবন বাঁচায়।
র্যাব কর্মকর্তা জানান, এ ঘটনায় কামারজানি আর্মি ক্যাম্পে হত্যাকাণ্ডের শিকার আকবর আলীর পুত্র আনিছুর রহমান বাদী হয়ে ২০১৩ সালে গাইবান্ধা অধস্তন আদালতে ধৃত আসামি আবু মুসলিম মোহাম্মদ আলী, আব্দুর রহিম, আবু সালেহ, আব্দুল লতিফ, রুহুল আমিন, নাজমুল হুদাকে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। ২০১৪ সালে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে স্থানান্তর করা হয়। বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি কখনোই আদালতে হাজির হননি। মামলা রুজুর পর ২০১৩ সাল থেকেই তিনি নিজ এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর গভীর তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত প্রতিটি অভিযোগ প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমাণিত হলে ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। এই মামলার অভিযুক্ত অপর পাঁচজন আসামির মধ্যে বর্তমানে একজন জর্ডানে অবস্থানরত, একজন কারাগারে, দুজন পলাতক এবং একজন পলাতক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ জানান, মামলা দায়েরের পর ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ধৃত আসামি সুন্দরগঞ্জ থানায় তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন। ২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে চলমান মামলায় তিনি জামিনের আবেদন করলে আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে। এরপর ট্রাইবুন্যালে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে ২০১৬ সালে তিনি পূর্বস্থল থেকে পালিয়ে গাইবান্ধা তিস্তা নদীর তীরে অবস্থিত বেলকার চর নামক নির্জন একটি চরে গিয়ে আত্মগোপনে থাকেন। তখন তিনি দিনমজুরির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন। পরে ২০২১ সালে ঢাকায় পালিয়ে এসে সাভার আশুলিয়া এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। এখানেও প্রথমে দিনমজুরি এবং পরে গৃহ শিক্ষকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। আত্মগোপনে থাকাকালীন তিনি ব্যক্তিগত পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মনাম ব্যবহার করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি গ্রেফতারের ভয়ে গত জানুয়ারি মাসে ওই স্থান ছেড়ে রাজধানীর ডেমরা এলাকায় একটি বস্তিতে অবস্থান নেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৩ তাকে সেখান থেকে গ্রেফতার করে।