নিয়ম করে প্রতিবছরই বন্যার শিকার বাংলাদেশ। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তবে চলতি বছর বন্যা যেমন দীর্ঘায়িত হয়েছে, তেমনি অন্যবারের চেয়ে উপদ্রুত এলাকাও বেশি। এমনিতেই বন্যায় দুর্ভোগের শেষ নেই। এর সাথে আবার যোগ হয়েছে নদীভাঙন। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে নদীপাড়ের মানুষ।
বানভাসি মানুষ দুর্ভোগ পোহালেও ঘরবাড়ি অনেকটা অক্ষতই রয়ে যায়। কিন্তু নদীভাঙনের শিকার মানুষের তাও থাকে না। সেই নদীভাঙনের শিকার মানুষের তুলনায় বানভাসিদের সৌভাগ্যবানই বলতে হয়। বন্যার পানিতে দীর্ঘ সময় জনজীবন বিপর্যস্ত ছিল বানভাসি মানুষের। নদীভাঙনের ফলে বাড়িঘর হারানো এসব অসহায় সম্বলহীন নিঃস্ব মানুষ এখন পরিবার পরিজন নিয়ে রাস্তা ও বাঁধের ওপর আশ্রয় নিচ্ছেন।
সব হারানো এসব মানুষের চোখে মুখে এখন শুধুই অন্ধকার। বন্যা কবলিত কয়েকটি জেলা প্রশাসন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে মাঠে কাজ করলেও অধিকাংশ জেলা প্রশাসন কাজ শুরু করতে পারেনি। কারণ, সরকারি বিধি মোতাবেক স্থানীয় নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচে নেমে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর থেকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে মাঠে নামতে হয়। এখনও সেই সময় আসেনি।
এই মুহূর্তে বন্যাকবলিত ৩৩ জেলার ১০১টি পয়েন্টের মধ্যে ৬৩টি পয়েন্টের পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, বাকি ৪টি পয়েন্টের পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। কাজেই ১০১টি পয়েন্টের পানি বিপদসীমার নিচে গেলেই ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ শুরু করবে জেলা প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বন্যার পানি কমতে শুরু করায় অনেকেই বাড়িঘরে ফিরছেন। দীর্ঘ সময় পানির নিচে তলিয়ে থাকা ঘর-দুয়ার ঠিক করে বসবাসের উপযোগী করার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন সবাই। কিন্তু এখানেও দেখা নেই স্বস্তির। নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন।
নদীভাঙনে ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে শত শত বাড়িঘর, স্কুল কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনা, হাটবাজার, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন এলাকার নদীভাঙন এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা বন্যায় কঠিন সময় অতিবাহিত করছেন ৩৩ জেলার মানুষ। কোরবানির ঈদের ছুটির মধ্যে বন্যার পানি বাড়লেও এখন কমতে শুরু করেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া দৈনিক দুর্যোগ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশন ১০১টি। এরমধ্যে এই মুহূর্তে ১২ জেলার ২০টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৩ জেলার ৬৩ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরিবর্তিত রয়েছে ২০ জেলার ৪টি পয়েন্টের পানি প্রবাহ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, দেশের বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশই উন্নতি হলেও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে নদীভাঙন। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে এই নদীভাঙন। সরকারের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসন বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হিসাব নিরূপণে মাঠে কাজ শুরু করেছে।
সম্প্রতি জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যায় বাংলাদেশের সাতটি জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলাগুলো হচ্ছে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, সুনামগঞ্জ ও শরীয়তপুর। এরমধ্যে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলায় বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও অন্য জেলায় এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, এসব জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীর পানি নেমে যাওয়ার স্থানীয় মানুষের জীবন স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে কমপক্ষে আরও এক বছর। ২০২১ সালের মার্চের আগে এসব এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে না। এই সাত জেলার মানুষকে পুনর্বাসনে সহায়তা দিতে প্রয়োজন হবে কমপক্ষে ৩৩০ কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বন্যার পানি নামতে শুরু করায় নদীভাঙনের কারণে এসব জেলার মানুষ নতুন করে বিপদে পড়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জামালপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হক জানিয়েছেন, জেলার প্রতিটি উপজেলার ওপর দিয়ে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনও কয়েকটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তারপরও এ পর্যন্ত নদীভাঙনের ফলে ৩৮৬টি বাড়ির ৫৪৯টি ঘর সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। বন্যায় ১৩ হাজার ৭৩৮টি ঘরের আংশিক ক্ষতি হয়েছে। ১২ হাজার ৮৬৩ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে।
গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক আব্দুল মতিন জানিয়েছেন, বন্যার পানি কমছে, তবে নতুন বিপদ নদীভাঙন। বহু মানুষই নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আমরা তাদের তালিকা করছি। তবে বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে এ তালিকা চূড়ান্ত করতে কিছুটা সময় লাগবে।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর জানিয়েছেন, নদীভাঙনের ফলে জেলার ২৫৭টি পরিবার বাড়িঘর হারিয়েছেন। তাদের সাময়িক সহায়তা বাবদ ৭ হাজার (জিআর ক্যাশ) টাকা ও ২০ কেজি করে জিআর চাল সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এদের নতুন ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে।
এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, বন্যার পানি এখন নামতে শুরু করলেও কবলিত ৩৩ জেলার ১০১টি পয়েন্টের সব পয়েন্টে পানি বিপদসীমার নিচে নামেনি। প্রতিটি পয়েন্টের পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার এক সপ্তাহ পর থেকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ শুরু করা হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবার প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারি সহায়তা পাবেন।
তিনি জানান, নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো চাইলে তাদের নিজস্ব জমিতে ঘর তৈরি করে দেবে সরকার। যদি তাদের নিজস্ব জমি না থাকে তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে জমি কিনে তাদের ঘর বানিয়ে দেওয়া হবে। এটি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ।