পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকেই দ্রুত এগিয়ে চলেছে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। সেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এ অঞ্চলের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে। স্বপ্নের খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পের কাজ এখন শেষের পথে। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এখন শুধু বাকি রয়েছে রেলপথের ফিনিসিং এবং সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজ। নভেম্বর মাসেই এটি চালু হওয়ার হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৭৩ বছর পর রেল যোগাযোগে সঙ্গে যুক্ত হবে। বাণিজ্যিক যোগাযোগ সম্প্রসারণে বন্দরকে রেলসেবার আওতায় আনা হচ্ছে। আর একে ঘিরে বাড়বে মোংলা বন্দরের গতিশীলতাও। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আসবে। তেমনি মোড় ঘুরবে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির চাকা । সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, ভারত সরকারের ঋণ সহায়তা চুক্তির আওতায় খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান লার্সেন অ্যান্ড টার্বো এবং আরেক ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। ২০১০ সালে খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। এরপর এর সম্ভ্যবতা যাচাই, ডিজাইন চুড়ান্ত, দরপত্র আহ্বান ও ঠিকাদার নিয়োগসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রকল্পটি তিনটি ভাগে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে: প্যাকেজ ১-রেললাইন নির্মাণ, প্যাকেজ ২-রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু এবং প্যাকেজ ৩-টেলিযোগাযোগ ও সিগন্যালিং সিস্টেম। এসব প্রকল্পের আওতায় মূল লাইনসহ রেলওয়ে ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য ৮৬ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ। আর রূপসা নদীর ওপর নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচ দশমিক ১৩ কিলোমিটার রেলসেতু। ইতিমধ্যে ওই সেতুর কাজ প্রায় শতভাগ শেষ। এদিকে, এ প্রকল্পের ৯১ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে বসানো সম্পন্ন হয়েছে ৮৬ কিলোমিটার। এছাড়া ১১টি প্লাটফর্ম, ১০৭টি কালভার্ট, ৩১ ছোট ব্রিজ ও ৯টি আন্ডারপাসের সবগুলোই নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এরই মধ্যে গত জানুয়ারি মাসে প্রকল্পের ফুলতলা অংশে পরীক্ষামূলকভাবেও চলেছে রেল। সব মিলয়ে এখন খুলনা-মোংলা রেল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। শেষ পর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে রেলপথের ফিনিসিং এবং সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশনের কাজ চলছে। প্রকল্পটি ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায়ও কাজ বাধাগ্রস্থ হয় বেশ কয়েকবার। পাঁচ দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বশেষ সেপ্টেম্বর মাসে এ কাজ শেষ করার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়। অবশেষে এখন কাজ একেবারেই শেষ পর্যায়ে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন ২৫ জুন সপ্তম ও শেষ স্প্যানটি বসে রূপসা রেলসেতুতে। রেলসেতুর ভায়াডাক্টের ৮৫৬টি পাইল বসানো হয়েছে। মূলসেতুর পাইল ৭২টি, পাইল ক্যাপ আটটি, বিয়ারিং ৩২টি সম্পন্ন হয়েছে। সেতুটির উপরিভাগ তৈরি করা হয়েছে স্টিলের গার্ডার এবং আরসিসি ডেকের সমন্বয়ে। এর মধ্যে রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণ করে লার্সেন অ্যান্ড টার্বো এবং রেল লাইন নির্মাণের কাজ করে ইরকন ইন্টারন্যাশনাল। সরেজমিনে দেখা যায়, রেলপথের শেষ প্রান্ত মোংলা স্টেশনে শেষ সময়ে ডাম্পিং মেশিনের সাহায্যে রেললাইন সমান করা, পাথর বসানোসহ অন্যান্য কাজে ব্যস্ত নির্মাণ শ্রমিকরা। ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইরকন ইন্টারন্যাশনালের সুপার ভাইজার গৌতম কুমার জানান, এখন আমরা একেবারেই শেষ সময়ের কাজ করছি। রেলপথ বসানো সম্পন্ন হয়েছে; এখন রেললাইনগুলো ডাম্পিং মেশিনের সাহায্যে সমান করা হচ্ছে; পাথরগুলো এক জায়গায় করা হচ্ছে; লেভেলিং ও রেলের বগির চাপ ঠিকভাবে যেন নিতে পারে সে কাজগুলো করা হচ্ছে। এ পর্যায় শেষ করা গেলেই সেতু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে। প্রকল্পটির নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ মাসুম হোসেন বলেন, ‘আমাদের কাজ শেষ। এখন মূলত ফিনিশিং ওয়ার্ক চলছে। এখন রেলপথে গাড়ি চলাচলের জন্যে তেরী। খুলনা-মোংলা রেলপথ প্রকল্পের পরিচালক মো. আরিফুজ্জামান বলেন, খুলনা থেকে মোংলা পর্যন্ত ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী নভেম্বর যে কোন দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন বলে আমি আশা করি। তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে চার হাজার ২৬০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় লোন রয়েছে দুই হাজার ৯৪৮ কোটি এক লাখ ৮৪ হাজার টাকা। বাকি এক হাজার ৩১২ কোটি ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা সরকারি ফান্ড থেকে ব্যয় হবে।’ মোংলা বন্দরের ব্যবসায়ী ইমরান শেখ ও রুবেল হোসেন বলেন, মোংলা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর হলেও এখানে রেল সংযোগ ছিল না। ফলে বন্দরটিতে অন্যান্য দেশের বড় মালবাহী জাহাজ ভিড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। বড় বড় জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিরত। এতে মোংলা বন্দরের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হত। যদিও মোংলা বন্দরকে রেলসেবার আওতায় আনতে ইতোপূর্বে একাধিক পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ সম্প্রসারণে বন্দরকে রেলসেবার আওতায় আনা হচ্ছে। এতে ব্যবসা- বাণিজ্য ও এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আসবে।
বাগেরহাট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শেখ লিয়াকত হোসেন লিটন বলেন,‘বন্দরে আমদানী-রপ্তানীর জন্য রেললাইন খুবই গুরুত্বপুর্ন। নিরাপদে এবং কম খরচে দ্রুত মালামাল বহন করা যায় রেলে। মোংলা বন্দরসহ এ অঞ্চলের সাধারন মানুষের একটা স্বপ্ন ছিল ‘রেললাইন’, সেই স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমেই বাস্তব হচ্ছে। খুলনা-মোংলা রেললাইন চালু হলে এ অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী হবে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী বলেন, খুলনা-মোংলা রেললাইন এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণের জেলাগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটবে। ‘মোংলা বন্দর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বন্দরের সঙ্গে রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। এখন খুলনা-মোংলা রেলপথ চালু হলে সড়কপথে পণ্য পরিবহনের চাপ কমবে। সেইসঙ্গে পণ্য পরিবহন ব্যয় ও সময় কমবে। পাশাপাশি বন্দরের নৌ, সড়ক ও রেলপথের মাল্টিমোডাল যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে ভারত, নেপাল ও ভুটানের পণ্য পরিবহন সহজ হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে। সেইসঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি আসবে।