প্রতিবছরই বিপর্যয় ঘটছে সাদা সোনাখ্যাত চিংড়ি চাষে। জলবায়ুর প্রভাব, রোগ-বালাইসহ নানাবিধ কারণে উৎপাদনের আগে চিংড়ি মারা যাওয়ায় ক্রমাগত লোকসানে আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েক লাখ চাষী। চিংড়ি চাষীরা যখন হতাশায় দিন পার করছে ঠিক তখনই মৎস্য অধিদপ্তর তাদেরকে সংগঠিত করে দেখিয়েছেন নতুন সম্ভাবনা ও আশার আলো। সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতাধীন গঠিত তিনশ’ ক্লাস্টারের সাড়ে সাত হাজার চিংড়ি চাষী বিপর্যয়ের মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। ক্লাস্টার চিংড়ি চাষী ও মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ চিংড়ি চাষের উপর নির্ভরশীল। বিগত কয়েক বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘের ভেসে যাওয়াসহ নানা রোগ বালাইয়ে চিংড়ি চাষীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। একপর্যায়ে মৎস্য অধিদপ্তরের নির্দেশনায় পরীক্ষামূলক বেশ কিছু ঘের ক্লাস্টার পদ্ধতিতে (উন্নত সনাতন) চাষ করলে তাদের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। তবে সনাতন পদ্ধতির ঘেরগুলো এ পদ্ধতিতে চাষের উপযোগী করতে ও চাষকালীন সময়ে বড় ধরণের খরচ হয়। অনেকের ইচ্ছা থাকার পরেও পূঁজি সংকটে উন্নত সনাতন এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করতে পারছেন না। এসব বিবেচনা করে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে মাছ চাষে প্রকল্প নেওয়া হয়। সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় মাছ চাষীদের সুসংগঠিত করে ৩০০ ক্লাস্টারকে প্রকল্পভূক্ত করা হয়। প্রতিটি ক্লাস্টারে রয়েছে ২৫ টি ঘের। যেসব ঘেরের আয়তন ৩৩ শতক থেকে ১৫০ শতক। ক্লাস্টারের চাষীদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধি, জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত, রাস্তা চওড়া ও উচু করা, পিসিআর ল্যাবে পরীক্ষিত ভাইরাসমুক্ত পিসিএফ পোনা মজুদ ও গুড এ্যাকোয়া কালচার প্রাকটিসে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘের প্রস্তুতির পর ক্লাস্টারগুলোকে ম্যাচিং গ্রান্ট (আর্থিক অনুদান) পাওয়ার জন্য আবেদন করতে বলা হয়। দুইশ’ ক্লাস্টারের চাষীরা একর (একশ শতক) প্রতি অফেরতযোগ্য এক লাখ ৮১ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান দেয়া হচ্ছে। যে অনুদান দিয়ে তারা চুন, প্রিবায়োটিক, প্রোবায়েটিক, পোনা, সম্পূরক খাদ্য ক্রয়, বিদ্যুৎ সংযোগ, অফিস কক্ষ নির্মাণ, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ যাবতীয় খরচ মেটাবে। তবে অধিকাংশ ক্লাস্টার চাষী পূঁজি সংকটে প্রকল্পের নির্দেশনা অনুযায়ী ঘের খনন ও রাস্তা নির্মাণে ব্যর্থ হয়। ফলে শর্তপূরণ সাপেক্ষে মাত্র ১০৭ টি ক্লাস্টার ম্যাচিং গ্রান্ট পেতে করতে সক্ষম হয় । তন্মাধ্যে যাচাই-বাছাই করে প্রথম দফায় ২৪ টি ক্লাস্টারকে ২৮ এপ্রিল ম্যাচিং গ্রান্টের চেক প্রদান করে মৎস্য দপ্তর। অনুদান পাওয়া ক্লাস্টারগুলো ভালো উৎপাদনের স্বপ্ন নিয়ে পোনা মজুদের প্রস্তুতি নিচ্ছে। চিংড়ি চাষীদের মধ্যে নতুন প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বড় ডাঙ্গা চিংড়ি চাষী ক্লাস্টার-১ এর সভাপতি সুভেন্দ্র বিশ্বাস বলেন, কয়েকবছর আগে মাত্র ৫টি ঘের নিয়ে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চাষ শুরু করি। মৎস্য অফিস থেকে তখন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে সফল হয়েছি। আগের চেয়ে দ্বিগুনের বেশি উৎপাদন বেড়েছে। এবার মৎস্য দপ্তরের পরামর্শে ২৫ টি ঘের প্রস্তুত করে ম্যাচিং গ্রান্ট পাওয়ার আশায় বসে ছিলাম। একটু দেরি হলেও আর্থিক সাপোর্ট পেয়ে আমরা খুশি। দেয়াড়া পশ্চিমপাড়া-১ চিংড়ি চাষী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ এনামুল হক বাবলু বলেন, আমরা মৎস্য কর্মকর্তাদের পরামর্শে অনেক আশা নিয়ে গত বছর ক্লাস্টার গঠন করি। মৎস্য অফিস থেকে দুই ধাপে পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ পেয়েছি। প্রশিক্ষণ অনুযায়ী চাষ করে উপকার পেয়েছি। তবে এবছর অর্থ সংকটে আমাদের ঘেরগুলো নির্দেশনা অনুযায়ী খনন ও রাস্তা তৈরি করতে পারিনি। আমাদের এলাকার অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র। অন্যান্য নির্দেশনা মানতে পারলেও গভীরতা বৃদ্ধির জন্য খননের টাকা সংগ্রহ করতে না পারায় স্বপ্ন ভেস্তে যাচ্ছে। ফলে অর্থের অভাবে ক্লাস্টার থেকে বাদ পড়ার শঙ্কায় আমরা চিন্তিত। ডুমুরিয়া সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চাষাবাদের ফলে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে। ডুমুরিয়ায় একই জমিতে গলদা ও বাগদা চাষ করা হচ্ছে। উৎপাদন দ্বিগুনেরও বেশি বেড়েছে। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে নিরাপদ মাছ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। লাভবান হওয়ায় ক্লাস্টার পদ্ধতিতে মৎস্য চাষে এ এলাকার মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। ডুমুরিয়ার মোট ১৮ টি ক্লাস্টার রয়েছে। ৫টি ক্লাস্টার ১ম দফায় ম্যাচিং গ্রান্টের চেক পেয়েছে। বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, বাগেরহাটে ৯৬টি ক্লাস্টার রয়েছে। এর মধ্যে শর্তপূরণ করে ম্যাচিং গ্রান্টের জন্য ১৬টি আবেদন করে। তন্মাধ্যে রামপালের ১টি, চিতলমারী ৩টি ও সদর উপজেলার ৩টি ক্লাস্টার আর্থিক সাপোর্ট পেয়েছে। মোংলা, মোরলগঞ্জ, কচুয়া ও ফকিরহাট উপজেলার ৯টি ক্লাস্টার ২য় ধাপে আর্থিক সাপোর্ট পেতে পারে। রামপালে ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে পোনা ছাড়া হবে। আশা করছি উৎপাদন অনেক বাড়বে এবং এ পদ্ধতিতে চাষীরা লাভবান হবে ইনশাল্লাহ। সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের খুলনা বিভাগের উপ-প্রকল্প পরিচালক সরোজ কুমার মিস্ত্রী বলেন, ক্লাস্টার হলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত খামারের সমষ্টি। ক্লাস্টার এমন একটি সংগঠন যা একটি নির্দিষ্ট এলাকার চাষীদের নিয়ে গঠিত হয় এবং সদস্যরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সমন্বিত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একই পদ্ধতিতে কাজ করে। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ নিরাপদ চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি, উপকূলীয় কৃষি অর্থনীতির উন্নয়ন, দারিদ্র বিমোচন এবং এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। তিনি আরও বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধিতে এটি একটি কার্যকরী উপায়। দক্ষিণ উপকূলের সকল চাষীদের সুসংগঠিত করে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ করতে পারলে চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচন হবে। এছাড়া জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে।