জেলা শহর থেকে সবচেয়ে দূরবর্তী ও দুর্গম এলাকা খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনী) চিকিৎসক থাকতেও মিলছে না গর্ভবতী ও স্ত্রী রোগের চিকিৎসা সেবা। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ফাতেমা জোহরা খামখেয়ালী মত রোগী দেখছেন। তিনি মাসে মাত্র ৮ থেকে ১০ দিন দায়সারাভাবে সেবা দিয়ে পুরো মাসের বেতন ভোগ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে সুন্দরবন ঘেঁষা উপকূলের লক্ষাধিক নারী চিকিৎসা সেবা থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশেষ করে প্রসূতিদের জরুরী সি-সেকশনের প্রয়োজন হলে চরম বিপদে পড়তে হচ্ছে। ৫ থেকে ৬ ঘন্টার পথ অতিক্রম করে জেলা শহরে যেতে একদিকে বাড়ছে ব্যয়, অন্যদিকে নিতে হচ্ছে চরম ঝুঁকি। স্থানীয় ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনী) পদ কয়েকবছর যাবৎ ফাঁকা ছিল। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদনের পাশাপাশি দাপ্তরিকভাবে চাহিদা প্রেরণের প্রেক্ষিতে গেল বছরের ৬ ডিসেম্বর জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনী) পদে ডা. ফাতেমা জোহরা নামে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যোগদান করেন। দীর্ঘদিনের প্রত্যশা পূর্ণ হওয়ায় খুশির জোয়ারে ভাসে উপকূলবাসী। তবে ওই চিকিৎসকের দায়িত্ব অবহেলায় সেই আনন্দ ম্লান হয়েছে। ডা. ফাতেমা জোহরা কয়রায় যোগদান করেই চলে যান শহরে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ২৯ ডিসেম্বর প্রেষণে খুলনা সদর হাসপাতালে সংযুক্ত হন। সচেতনমহলের দাবির মুখে খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ ৩০ জানুয়ারী তার প্রেষণ বাতিল করলে ৪ ফেব্রুয়ারী ফের কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগদান করেন। তবে প্রেষণ বাতিলের পরেও কর্মস্থল কয়রায় অবস্থান করছেন না। জেলা শহর খুলনায় নিয়মিত প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখছেন। খুলনা থেকে এসে কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সপ্তাহে কখনও একদিন কিংবা দুই দিন দায়সারাভাবে রোগী দেখছেন। যোগদানের পর থেকে সর্বোচ্চ তিন দিনের বেশি কোন সপ্তাহে আসেননি বলে জানা যায়। তিনি যে দিন কয়রায় আসেন সেদিনই খুলনায় ফিরে যান। আসা-যাওয়ার সময়ের মধ্যে মাত্র কয়েক ঘন্টা হাসপাতালে বহিঃবিভাগে দায়সারাভাবে রোগীর সেবা দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে, কয়রায় প্রতি সপ্তাহে নূন্যতম ১৫/২০ জনের সি-সেকশন প্রয়োজন হলেও যোগদানের পর থেকে অদ্যবধি কোন অস্ত্রোপচার করেননি। ফলে চিকিৎসক থাকতেও গর্ভবতীদের বাড়তি খরচ করে যেতে হচ্ছে জেলা শহরে। অনেকে খরচের ভয়ে ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে ডেলিভারী হতে যেয়ে বিপদের সম্মূখীন হচ্ছেন। কেউ কেউ নিম্নমানের ক্লিনিকে যেয়েও বিপদে পড়ছেন। অনেকে হারাচ্ছেন তাদের গর্ভের সন্তান। এমনকি প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। শারমিন নামের এক নারী বলেন, আমার পিরিয়ডের সময় প্রচুর তলপেট ব্যথা করে। অনিয়মিত হচ্ছে। শুনেছি হাসপাতালে ভালো একজন ডাক্তার আসছেন, তবে সেখানে যেয়ে পাইনা। কবে আসবেন সেটাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। প্রাইভেট দেখানোর মত ভালো কোন মহিলা চিকিৎসকও কয়রাতে পাওয়া যায় না। খুলনায় যেতে অনেক খরচ। এজন্য রোগ পুষে কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। শাহানারা খাতুন নামের অন্য একরোগী জানান, গাইনী ডাক্তারের কাছে পরামর্শের জন্য বেশ কয়েকদিন ধরে খোঁজ নিচ্ছেন। তবে কখন আসেন আর কখন যান দেখা পাওয়া দুস্কর। সম্প্রতি মহারাজপুর ইউনিয়নের জাহিদুল ও নাজমা দম্পতির সন্তান মারা যায়। হাসপাতালে ডাক্তার না থাকায় ক্লিনিক থেকে আল্ট্রাসনো রিপোর্ট করে খরচের ভয়ে তারা ডেলিভারীর জন্য বাড়িতে থাকেন। একপযায়ে পেটের মধ্যে সন্তান মারা যায়। পরে ক্লিনিক থেকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মৃত সন্তান বের করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. ফাতেমা জোহরা বলেন, ওখানে তিন দিন সিভিল সার্জন স্যার থাকেন, আমি তিন দিন যাই। যে সপ্তাহে যেরকম লাগে সেরকম যাই। মাঝেমধ্যে ছুটি নেই। আবাসন ব্যবস্থা ভালো না থাকায় যেয়ে চলে আসতে হয়। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সিভিল সার্জন অথবা টিএইচও এর সাথে কথা বলার জন্য বলেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রেজাউল করিম বলেন, হাসপাতালে আবাসন ব্যবস্থা না থাকায় অনিয়মিত আসা-যাওয়া মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। মৌখিকভাবে তাকে একাধিকবার সতর্ক করা হয়েছে। এ বিষয়ে খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদ বলেন, কনসালটেন্ট হিসেবে তারতো ওখানে দায়িত্ব নেয়া উচিত। তিনি যদি যথাযথ দায়িত্বপালন না করেন তাহলে জবাবদিহি করতে হবে। যাতে তিনি নিয়মিত কাজ করেন সে ব্যাপারে তাকে তাগিদ দেয়া হবে। খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো: মনজুরুল মুরশিদ বলেন, লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর আমি কোন গাইনী চিকিৎসককে উপজেলা পর্যায় থেকে জেলা সদরে সংযুক্তি করিনি এবং সিভিল সার্জনদেরও এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করি।