খুলনার কয়রা উপজেলার বিসমিল্লাহ সিরাতে মুহাম্মদ (বে-সিন-মীম) বায়লারহারানিয়া আলিম মাদ্রাসার কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি এমন নারীকে আয়া পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সম্পর্কিত তথ্যের জন্য প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের কাছে দুই মাস যাবৎ একাধিকবার চাওয়ার পরেও কোন ডকুমেন্টস দেননি। এমনকি তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী গত ১৬ মার্চ পরীক্ষার্থীদের তথ্য চেয়ে আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত কোন তথ্য মেলেনি। সরেজমিন সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে ও নিয়োগপ্রাপ্ত প্রার্থী সূত্রে জানা যায়, ১২ জুন ২০২২ ইং তারিখে দৈনিক প্রবাহ পত্রিকায় কর্মচারী নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ি সর্বনিম্ন বয়সসীমা নির্ধারিত না থাকায় বায়লারহারানিয়া গ্রামের মোঃ মনিরুজ্জামান মন্টুর মেয়ে শিউলী আক্তারসহ বিভিন্ন পদে বেশ কয়েকজন আবেদন করেন। আবেদনপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ৯ ডিসেম্বর পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য প্রবেশপত্র প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ শেষে ওই শিউলী আক্তারকে আয়া পদে ১০ ডিসেম্বর নিয়োগপত্র দেয়া হয় এবং ১১ ডিসেম্বর কর্মস্খলে যোগদান নিজ পদের দায়িত্ব পালন করেন। একপর্যায়ে শিউলীর বেতনের (এমপিওভুক্ত) জন্য তার নামে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলতে যেয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় বাঁধা আসে। আর অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে কিভাবে চাকরী পেয়েছে এ নিয়ে এলাকায় নানা গুঞ্জনের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে বিষয়টি এ প্রতিবেদকের নজরে আসে। খোঁজখবর নিয়ে ফেব্রুয়ারী মাসে অধ্যক্ষের কাছে জানতে চাইলে তখন সংবাদকর্মীদের সাথে ফলাফল স্থগিতের কথা বলেন। আর বিষয়টি ধামাচাপা দিতে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের তথ্য চাওয়ার পরেও তালবাহানা করতে থাকেন। একপর্যায়ে শিউলীর স্থলে কয়রার মহারাজপুর ইউনিয়নের দেয়াড়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের মেয়ে মরিয়াম খাতুনকে গোপনে নিয়োগ দেয়া হয়। তবে নিয়োগ কমিটির সকলকে ম্যানেজ করে মরিয়মের যাবতীয় কাগজপত্র মাদ্রাসা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। অভিযোগ রয়েছে মরিয়াম খাতুন নামে কেউ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। এমনকি ওই মরিয়াম খাতুন আবেদনও করেননি বলে মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির এক সদস্য ও এক শিক্ষক জানান। এসব ধামাচাপা দিতে মিডিয়াকর্মীদের সঠিক তথ্য না দিয়ে এক এক সময় এক এক ধরণের কথা বলা হয়। আর প্রতিবেদন বন্ধের জন্য প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার নাম ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন অপকৌশল প্রয়োগ করা হয়। মাদ্রাসায় সরেজমিন যাওয়ার পর ও মোবাইল ফোনে একাধিকবার প্রার্থীদের ডকুমেন্টস দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন অধ্যক্ষ মাওলানা মোসাররফ হোসেন। তবে ডকুমেন্টস না পেয়ে গত ১৬ মার্চ তথ্য অধিকার আইনে অধ্যক্ষের কাছে আবেদন করা হলেও অদ্যবধি কোন ডকুমেন্টস দেননি। এমনকি অপারগতা প্রকাশ করেও কোন লিখিত পত্র দেননি। প্রথম নিয়োগ পাওয়া শিউলী আক্তার বলেন, আমি বিজ্ঞপ্তির শর্ত পালন করে আবেদন করি। পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পরে আমাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। মাদ্রাসায় যোগদানের পরে একমাস কাজও করি। পরে বয়সের দোহাই দিয়ে আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে। আমি সুস্থ বিচার চাই। নিয়োগ পাওয়া অপর প্রার্থী মরিয়াম খাতুন বলেন, আমি যথাযথ নিয়ম অনুযায়ি নিয়োগ পেয়েছি এবং বেতনও পাচ্ছি। অপ্রাপ্ত বয়সে নিয়োগের বিষয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও নিয়োগ বোর্ডের সদস্য সচিব মাওলানা মোসাররফ হোসেনের কাছে তৎকালীন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিয়োগ বিধিতে সর্বনিম্ন বয়সসীমা উল্লেখ না থাকায় আমরা যাচাই-বাছাইতে শিউলীকে বাদ দেয়নি। শিউলী আক্তার নিয়োগ পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তবে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় একটু সমস্যা হচ্ছে। আমরা ফলাফল স্থগিত করে রেখেছি। এখনও কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। তবে সম্প্রতি মরিয়ামের গোপন নিয়োগ প্রকাশ্যে আসার পরে কিভাবে তাকে নিয়োগ দেয়া হলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিউলী আক্তার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। আর মরিয়াম খাতুন যথাযথ নিয়মে আবেদন ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। মরিয়াম প্রথম হওয়ায় তাকে যথাযথ নিয়ম অনুযায়ি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে নিয়োগ দেওয়ার পরেও প্রতিবেদককে ফলাফল স্থগিত বলার কারণ জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। নিয়োগ বোর্ডের সদস্য এসএম আব্দুল হক বলেন, কয়েকটি পদের নিয়োগ পরীক্ষা একসাথে হয়। আমি লিখিত পরীক্ষার সময় অন্য কক্ষের দায়িত্বে থাকায় আয়া পদে কারা অংশগ্রহণ করেছেন জানিনা। আমি ভাইভা পরীক্ষার সময় ছিলাম। শিউলী ও মরিয়াম কাউকে ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেখিনি। আমি কাউকে কোন নম্বর দেইনি। অধ্যক্ষ ও ডিজির প্রতিনিধি নম্বর দিয়েছিল আর আমি তাদের ফলাফল শীটে স্বাক্ষর করি। মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটি ও নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি রবিউল ইসলাম বলেন, মরিয়াম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং নিয়ম অনুযায়ি নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শিউলী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। বয়স কম থাকায় যাচাই বাছাই থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়। তবে শিউলী খাতুনের নিয়োগপত্র দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে অধ্যক্ষ সব কিছু জানেন, আমি বেশি কিছু জানিনা। একপর্যায়ে নিয়োগপত্র দেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। নিয়োগ বোর্ডে মাদ্রাসা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি ও খুলনা আলিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা জাকারিয়া বলেন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক হলেও নিয়োগ দেওয়া যায়। তবে বেতন হবে না। আমি ফলাফল তৈরি করে দিয়ে এসেছিলাম। পরবর্তীতে তারা কি করেছেন এটা আমার জানা নেই। ওখানে অনেক ঝামেলা। খুলনা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, আলিম পর্যায়ের মাদ্রাসাগুলো আমাদের আওতাধীন নয়। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। এ বিষয়ে আমাদের কোন দায়িত্ব নেই। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকার পরিদর্শক (খুলনা বিভাগ) মুহাম্মদ হোসাইন বলেন, কোন বৈধ প্রার্থী নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পরে তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি চাকরী করতে না পারলেও নতুনভাবে সার্কুলেশনের মাধ্যমে নিয়োগ দিতে হবে। তবে অবৈধ প্রার্থীপ্রথম হলে তার পরিবর্তে পরের জনকে নিয়োগ দেয়ার সুযোগ আছে। তিনি আরও বলেন, নিয়োগবিধিতে সর্বোচ্চ বয়সসীমা উল্লেখ থাকলেও সর্বনিম্ন বয়সসীমা উল্লেখ নেই। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া বেতনের জন্য এমপিওভুক্তির আবেদন করা যায় না। ফলে জাতীয় পরিচয়পত্র বিহীন কাউকে নিয়োগের সুযোগ নেই।