রেশমা আক্তার। দক্ষিণাঞ্চলের অজোপাড়া গাঁয়ের একটি দরিদ্র পরিবারে জন্ম। মেয়েদেরকে সংসারের বোঝা মনে করতেন পরিবারটি। ফলে পরিবারের সদস্যদের চোখের কাঁটা হয়ে জন্ম নিতে হয়। ভূমিষ্ট হওয়ার পরে পরিবারের এক সদস্যের কাছে দিলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কোলে নেননি। মেয়ে হওয়ায় একের পরে এক প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে বড় হতে থাকে। বাল্য বিয়ে হওয়ার পরেও সন্তান-সংসার সামলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগ নিয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বর্তমানে সুন্দরবন উপকূলীয় প্রত্যন্ত এলাকা কয়রা উপজেলায় প্রথম নিয়মিত মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করে নারীদের উন্নয়নে সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। রেশমা আক্তার খুলনার পাইকগাছা উপজেলার নাছিরপুর গ্রামের দিন মজুর আরশাদ আলীর কন্যা। তার স্বপ্ন ছিল বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার হওয়ার। ৩৭ তম বিসিএস পরিক্ষা দিয়ে তিনি নন-ক্যাডার হিসেবে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে চাকরি পেয়ে প্রমাণ করেন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রবল ইচ্ছা থাকলে আল্লাহর রহমতে সফলতা আসে।এখন তিনি পরিবারের সকলের চোখেরমনি। তার পরিবার মেয়ে হওয়া নিয়ে এখন আর দুশ্চিন্তা করে না। বরং মেয়ে চায়। এদিকে, ছোটবেলা থেকে লালিত স্বপ্ন বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার হওয়ার আশা এখনও বাদ দেননি। চাকরীর পাশাপাশি প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ৪১তম বিসিএস এর এমসিকিউ, লিখিত পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী ৭ মার্চ বাংলাদেশ সরকারী কর্ম কমিশনের আওতায় তার ভাইভা পরিক্ষা রয়েছে। রেশমা আক্তার বলেন, নানা প্রতিকূলতার মধ্যে একপর্যায়ে আমি স্বপ্ন দেখা ভুলে গিয়েছিলাম। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ভালো কিছু করার চেষ্টা করছি। আলহামদুলিল্লাহ, সফলতাও পেয়েছি। মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি নারীসহ অসহায়দের নিয়ে আরো বৃহৎ পরিসরে কাজ করার। এজন্য চাকরীর পাশাপাশি বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের ভাইভার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। ইনশাআল্লাহ এবার ভালো কিছু হবে। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার বহুদিনের স্বপ্ন পুরণে সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, আমাদের সমাজে অনেক নারী আছেন, যারা বিভিন্ন প্রতিকূলতায় পিছিয়ে পড়ে। তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। হাল না ছেড়ে ধৈর্য্য ধরে লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ তাদের জন্য । একদিন সফলতা আসবে ইনশাআল্লাহ। যারা বলতো আমাকে দিয়ে কিছু হবে না, আজ তাদের আদরের আমি। প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা সম্পর্কে রেশমা আক্তার বলেন, পরিবারে তেমন স্বচ্ছলতা ছিল না। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াবস্থায় পরিবার থেকে বিয়ের চাপ দিতে থাকে। ছেলেরা দেখতে আসতো। ইচ্ছা না থাকলেও পরিবারের চাপে তাদের সামনে যেতে হত। আব্বুর সহযোগিতায় এসএসসি পরিক্ষা পযন্ত অবিবাহিত থাকতে পারি। তবে একাদশ শ্রেণিতে পড়াবস্থায় ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। আমি যখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে আমার ছেলে তখন ক্লাস ওয়ানে পড়তো। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব, সন্তান সবকিছু একসাথে সামলিয়েছি। তিনি জানান, বিয়ের পরে শুরু হয় জীবনের আরেকটি অধ্যায়। সারাদিন সংসারের ঘানি টেনে রাতে সুযোগ পেলে কোন রকমে বই নিয়ে বসতেন। গর্ভে ৭ মাসের সন্তান নিয়ে তিনি এইচএসসি পরিক্ষা দেন। এরই মাঝে কোল আলো করে আসে ফুট ফুটে সন্তান। এইচএসসি পরিক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তবে কোলে দুগ্ধপানকারী সন্তান নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেও কৃতকার্য না হতে পারায় তার পিতা খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। তখন বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলেছিলেন, ইনশাআল্লাহ, পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবো। তবে সেটা বাস্তবে সম্ভব বলে মনে হয়নি তার। ভাবতেও পারেননি সেই আশ্বাস বাস্তব হবে। অদম্য নারী রেশমার সাথে কথা বলে আরও জানা যায়, প্রতিকূলতার মধ্যেও পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয় । তখন আরেক বাঁধা সামনে এসে দাঁড়ায় । একদিকে শ্বশুরবাড়ির সংসার সামলানো, অন্যদিকে সন্তান নিয়ে ঢাকায় যেয়ে লেখাপড়া করার জটিলতা। নতুন চাপের মুখে পড়েন তিনি। শ্বশুরবাড়ির পরিবার থেকে ঢাকায় যেতে বাঁধা দেয়া হয়। তবে স্বামীর সহযোগীতায় অনেক কষ্টে অবশেষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সন্তান-স্বামীর সংসার সামলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার করেন তিনি। সেখান থেকে প্রথম বিভাগ নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করেন। তখনও তাকে দিয়ে কিছু হবেনা বলতেন অনেকেই। এরপর ৩৭ তম বিসিএস পরিক্ষা দিয়ে তিনি নন-ক্যাডার হিসেবে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে চাকরি পেয়ে প্রমাণ করেন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও প্রবল ইচ্ছা থাকলে আল্লাহর রহমতে সফলতা আসে। এখন তিনি পরিবারের সকলের চোখেরমনি। তার পরিবার মেয়ে হওয়া নিয়ে এখন আর দুশ্চিন্তা করে না। বরং মেয়ে চায়। তার ছেলে এখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে আর মেয়ের বয়স তিন বছর। উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ৩১ আগস্ট খুলনার কয়রা উপজেলাতে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে কয়রা উপজেলায় নিয়মিত কোন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ছিলেন না। এ পদটি সবসময় অন্য উপজেলার কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে দেয়া হত। তিনি যোগদানের পর থেকে প্রত্যন্ত এলাকার বাড়ি বাড়ি যেয়ে নারীদের সরেজমিন খোঁজ নিতে দেখা যায়। নারীর ক্ষমতায়ন ও বাল্যবিবাহ নিরোধে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এসএম শফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি উপকূলীয় নারীদের উন্নয়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এ উপজেলাতে ভালোই কাজ করছেন।